রানী রাসমণির নাম আশা করি তুমি নিশ্চই জানো | মহিয়সী এই নারী একদিকে যেমন ছিলেন একজন সমাজ সেবক ঠিক তেমনই অন্যদিকে তিনি ছিলেন একজন ঈশ্বরপ্রেমী মানুষও |
আশা করি তুমি বাংলার জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল “করুণাময়ী রানী রাসমণির” মাধ্যমে তাঁর রঘুবীরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তির কথা জানতেই পেরেছ |
তিনি কিন্তু রঘুবীর ছাড়াও মা কালীরও ভক্ত ছিলেন তাইতো সেই সুবাদে তিনি, পরবর্তীকালে দক্ষিণেশ্বরে একটি কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৫৫ সালে, যেটাকে আজ আমরা সবাই দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির হিসাবেও চিনি |
দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির
রানী রাসমণির জন্ম হয় ২৬ সেপ্টেম্বর ১৭৯৩ সালে, বর্তমান উত্তর ২৪ পরগণার হালিশহরে অবস্থিত কোণা নামক একটা ছোট্ট গ্রামে | তাঁর বাবার নাম ছিলো হরেকৃষ্ণ দাস আর মায়ের নাম ছিলো রামপ্রিয়া দাসী |
জানা যায় হরেকৃষ্ণ দাস ছিলেন পেশায় একজন সাধারন দরিদ্র কৃষক ও গৃহনির্মাণকারী | ছোটবেলায় রাসমণির নাম তাঁর মা রামপ্রিয়া দাসীই প্রথম ভালোবেসে “রানী” রেখেছিলেন | পরে তাদের প্রতিবেশীদের দৌলতেই তাঁর নাম হয়ে যায় রানী রাসমণি |
রাসমণি কিন্তু অতি অল্প বয়সেই বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন | তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সেই কলকাতার যানবাজারের জমিদার রাজচন্দ্র দাসের সাথে বিয়ে করেন, সালটা ছিলো ১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দ |
এবার তোমার হয়তো এটা জানতে নিশ্চই ইচ্ছা করছে যে, কি করে রানী রাসমণির মত একটা গরিব পরিবারের মেয়ে, রাজচন্দ্র দাসের মতো এক ধনী ব্যবসায়ী তথা জমিদারকে বিয়ে করলো?
শোনা যায়, বাবু রাজচন্দ্র দাস নাকি ব্যবসায়িক কাজের সুত্রে একদিন ত্রিবেণীতে যাচ্ছিলেন, যেতে যেতে তিনি হঠাৎই পাশের গঙ্গার ঘাটে এক ১১ বছর বয়সই মেয়েকে দেখতে পান, যে সেখানে স্নান করতে এসেছিলো |
তাঁর রূপ ও মুখের লাবন্য দেখে সদ্য যৌবন প্রাপ্ত যুবক রাজচন্দ্র তাঁর প্রেমে পরে যান | সেইদিন রাজচন্দ্র আর ত্রিবেণীর উদ্দেশ্যে যেতে পারেননি এবং পুণরায় বাড়ি ফিরে আসেন |
এরপরেও তিনি আরো বেশ কিছুবার হালিশহরে, রাসমণির গ্রামে এসেছিলেন | সেখানে তিনি রাসমণির রূপ ও লাবন্য ছাড়াও তেজস্বীনী এবং দুয়ালু রূপের সাথেও পরিচিত হন | যারফলে তিনি রানীকে আরো গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেন |
অবশেষে রাজচন্দ্র দাস, তাঁর বাড়ির অনেক গুরুজনদের অমত থাকার পরেও রানীকে বিয়ে করে আনেন সেখানে | রাজচন্দ্র দাস ও রানী রাসমণির মোট ৫টা সন্তান হয়, যার মধ্যে তাদের প্রথম সন্তান জন্মের কিছু সময় পরেই মারা যায় | সে ছিলো তাদের প্রথম পুত্র সন্তান |
তাদের বাকি ৪টে সন্তানই ছিলো মেয়ে | যাদের নাম যথাক্রমে- পদ্মামনি,কুমারি,করুণা এবং জগদম্বা রাখা হয় |
রানী রাসমণি ও রাজচন্দ্র দুজনেই ভীষন দুয়ালু প্রকৃতির মানুষ ছিলেন | গরিব, দুঃখী, ভিক্ষুক কিংবা ক্ষুধার্ত মানুষ প্রত্যেকেরই রানী রাসমণি ও রাজচন্দ্র সেবা করে যেতেন মন প্রাণ উজার করে | কেউই অবহেলিত হতনা তাদের দয়া ও ভালোবাসা থেকে |
রাসমণি ও তাঁর স্বামী পরিবারের বেশিরভাগ সম্পদ সামাজিক কর্মকান্ড, ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানে ব্যয় করে দিতেন | এতে অবশ্য তাদের পরিবারের অনেকেই বিভিন্নভাবে অমত প্রকাশ করতেন কিন্তু তাতে তাঁরা দুজনে কোনোদিনই মানুষের সেবা বন্ধ করেননি |
জনসাধারণের জন্য স্নানঘাটের অসুবিধা দূর করতে তিনি বহু টাকা ব্যয় করে ফেলেন | তিনি ও তাঁর স্বামী রাজচন্দ্র, নিজের টাকায় কলকাতার বাবুঘাটকে বাঁধাতে সক্ষম হন | এরপর তারা তৈরী করেন আহিরীটোলা স্নানঘাট ও নিমতলা স্নানঘাটও |
কোলকাতার বাবুঘাট
এছাড়া বাবু রোড নির্মান সহ নিমতলা শ্মশান ঘাটে নিজের পারিবারিক জমির উপর পাকা বাড়ি নির্মানও করেন তারা |
রাসমণির উদ্যোগে তৈরী সবচেয়ে বিখ্যাত নিদর্শন হলো দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির, যেটা আমি লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি | কিন্তু আজ যে তুমি দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির দেখছ, সেটা তৈরীর পেছনেও রাসমণিকে সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষদের কাছ থেকে অনেক কথা শুনতে হয়েছিলো |
যেহেতু রাসমণির পিতৃ পক্ষের পরিবার সেইসময়কার সমাজ ব্যবস্থা অনুযায়ী নিম্নবর্ণের ছিলো তাই সমস্ত ব্রাহ্মণ সমাজ দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির নির্মানের কাজে প্রথমে বাঁধা সৃষ্টি করে | কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হয়নি, কারণ রাসমণি ব্রাহ্মণ সমাজের বাঁধা তোয়াক্কা না করে কালী মন্দির নির্মানের কাজ চালিয়ে যান |
পরে, দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের নির্মান কাজ শেষ হলে সেই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসাবে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসকে নিযুক্ত করা করা হয় |
এরপর আসি ১৮২০ সালে, বাংলায় তখন ভয়াবহ বন্যা | সেইসময় অনেক সাধারণ মানুষই বন্যার কবলে পরে নিজের বাড়ি-ঘর সহ সকল সম্পত্তি হারিয়েছিল | দয়াময়ী রানী রাসমণি প্রতিবারের মত সেইবারেও জনসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রচুর টাকা ব্যয় করেন |
জানা যায় সেই বছরেই রানী রাসমণির বাবা হরেকৃষ্ণ দাসও মারা যান | যেহেতু হরেকৃষ্ণের কোনো ছেলে সন্তান ছিলো না তাই সেহেতু রাসমণিই, মেয়ের কর্তব্য অনুসারে বাবার পরলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য গঙ্গার ঘাটে যান |
রানী রাসমণি ও রাজচন্দ্র দাসের বৈবাহিক জীবন বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি | রাজচন্দ্র দাস মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মারা যান | স্বামীর এই মৃত্যুতে রাসমণি ভীষনভাবে ভেঙ্গে পরেন | শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষটা যে এত কম বয়সে চলে যাবেন, তা তিনি কখনো ভাবতেও পারেননি |
আসলে যদি আজ আমরা ভালোভাবে বিচার করে দেখি, তাহলে আমরা এটা নিশ্চই বুঝে যাবো যে, রাসমণির এই বিশাল জনহিতকর কর্মকান্ডের পিছনে তাঁর স্বামী রাজচন্দ্রের অবদান ছিলো প্রচুর |
রাজচন্দ্র তাঁর স্ত্রীকে কোনদিনও জনহিতকর কাজ করার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই বাঁধা দেননি | সর্বদাই তাঁকে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি, পাশেও থেকেছেন একজন বন্ধুর মতো |
ঠিক একইভাবে রাসমণিও তাঁর স্বামীর প্রত্যেকটা পদক্ষেপে পাশে থেকেছেন | কোথাও ভুল করলে, স্বামীকে শুধরেও দিয়েছেন সদ পরামর্শের মাধ্যমে |
আগেকার দিনে স্বামীর কথাই ছিলো, প্রতেকটা স্ত্রীয়ের কাছে একদম শেষ কথা | স্বামীকে পরামর্শ দেওয়ার ভাবনাও ছিলো, একজন স্ত্রীয়ের কাছে বড় বিপদের |
কিন্তু রাজচন্দ্র দাস ছিলেন একদমই অন্য স্বভাবের মানুষ | তিনি আধুনিক ধ্যান ধারনায় বিশ্বাসী ছিলেন | তিনি নারীদের সন্মান দেওয়ার পাশাপাশি তাদের শ্রদ্ধাও করতেন ভীষনভাবে | তাই তিনি তাঁর স্ত্রীর পরামর্শকে শুনতেন এবং মেনেও চলতেন প্রয়োজন মতো |
এবার তবে জানা যাক রানী রাসমণির জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার সম্পর্কে:
১. জগন্নাথ দেবের পুজো উপলক্ষে একবার রানী রাসমণি, তাঁর পরিবার ও দাস-দাসীদের নিয়ে জগন্নাথ ধামের উদ্দেশ্যে (পুরী) যাচ্ছিলেন | যেতে যেতে তিনি লক্ষ্য করেন যে, সেখানকার রাস্তা ভীষনই খারাপ | বাকি তীর্থ যাত্রীদের খুব কষ্ট হচ্ছে সেই পথ ধরে তীর্থের উদ্দেশ্যে যেতে | সেই দেখে রানীর মন ভীষন দুঃখে ভরে ওঠে |
পরে তিনি তাদের সুবিধার কথা চিন্তা করে সমস্ত রাস্তা সংস্কার করে দেন | কিন্তু এখানেই তিনি থেমে থাকেননি, তখনকার সময় অনুযায়ী প্রায় ৬০ হাজার টাকা ব্যয় করে তিনি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা এই তিন বিগ্রহের জন্য হীরক খচিত তিনটি মুকুটও তৈরি করে দেন |
২. সারা ভারতে তখন ব্রিটিশ শাসন, বাংলার ইংরেজরা গঙ্গা নদীতে জেলেদের মাছ ধরার ক্ষেত্রে চড়া শুল্ক আদায় করে চলেছে | বাংলার দরিদ্র জেলেদের অবস্থা প্রায় বিপন্ন | অবশেষে রানী রাসমণি এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন এবং ইংরেজ সরকারকে চাপ দেন শুল্ক তোলার জন্য |
রাসমণির জেদের আগে ইংরেজ সরকারকেও হার মানতেই হয় | তারপর ইংরেজ সরকার জেলেদের গঙ্গায় মাছ ধরার বিনিময়ে শুল্ক নেওয়া বন্ধ করে অবশেষে | এরপর জেলেদের মাছ ধরার সুবিধার্থে গঙ্গায় চলাচলকারী কয়েকটি স্টিমার সার্ভিস বন্ধ করতেও তিনি সক্ষম হন | যারজন্য তাঁকে প্রচুর টাকাও ব্যয় করতে হয়েছিলো |
৩. তুমি আশা করি এটা জানোই যে, ব্রিটিশ আমলে ভারতীয়দের দিয়ে নীলচাষ করানো হত | একবার এক ইংরেজ নীলকর সাহেব বর্তমান বাংলাদেশের মকিমপুর অঞ্চলের মানুষজনদের, জোর করে নীলচাষ করানোর জন্য ভীষন অত্যাচার করতে থাকে |
এই কথা জানতে পেরে রানী রাসমণি ছুটে যান সেখানকার মানুষদের সাহায্য করতে | পুণরায় তাঁরই হস্তক্ষেপে সবকিছু বন্ধ হয়ে যায় আগের মতো | তিনি প্রজাদের উন্নতির জন্য প্রায় এক লক্ষ টাকা খরচ করে একটা খাল খনন করে দেন যারফলে মধুমতী নদীর সঙ্গে গঙ্গার সংযোগ স্থাপন হয় |
এরপর পর পরই তিনি কলকাতায় এসে বেলেঘাটা এবং ভবানীপুরে বাজার স্থাপন করেন আর কালিঘাট নির্মান করেন |
রানী রাসমণির শ্বেত মূর্তি
রানী রাসমণি ছিলেন একজন দৃঢ় স্বভাবের নারী | তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, সমসাময়িক বাকি নারীদের থেকে অনেক বেশি পরিনত ছিলো | তাঁর সবচেয়ে বড় গুন ছিলো, তিনি যেই কাজকে একবার সঠিক বলে মনে করতেন, সেই কাজকে তিনি সম্পূর্ণ করেই ছাড়তেন যতই বাঁধা বিপত্তি আসুক না কেন |
তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, মানুষের সেবা কীভাবে ভক্তিপূর্বক করতে হয় | তিনি কোনদিনও জনসাধারণের থেকে তাঁর সেবার বিনিময়ে কিচ্ছু পাওয়ার আশা করেননি বরং তাদেরই সর্বদা উপহার হিসাবে দিয়ে গেছেন বিভিন্ন জিনিস |
তাঁর মহান কর্মই তাঁকে আজ করে তুলেছে সকলের কাছে চিরস্মরনীয় |
অর্থের সঠিক ব্যবহার, তাঁর কাছ থেকেই আমাদের প্রতেক্যের শেখা উচিত | কারন বর্তমানে এমন অনেক মানুষই আছে, যারা টাকা তো উপার্জন করছে প্রচুর কিন্তু সেটা শুধু নিজেদেরই জন্য |
অসহায় মানুষদের সাহায্যের কথা ভাবা, তাদের কাছে শুধু সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয় | যদি সেইসব মানুষরা আজ রানী রাসমণির মতো মানুষদের সেবা করতে শুরু করে, তাহলে ভারতে একসময় কেউ আর দরিদ্র, ক্ষুধার্ত ও অসহায় থাকবে না |
অবশেষে ১৮৬১ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারী, প্রায় ৬৮ বছর বয়সে এই মহান মহিয়সী নারীর জীবনাবসান হয় |
আশা করি তুমি বাংলার জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল “করুণাময়ী রানী রাসমণির” মাধ্যমে তাঁর রঘুবীরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তির কথা জানতেই পেরেছ |
তিনি কিন্তু রঘুবীর ছাড়াও মা কালীরও ভক্ত ছিলেন তাইতো সেই সুবাদে তিনি, পরবর্তীকালে দক্ষিণেশ্বরে একটি কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৫৫ সালে, যেটাকে আজ আমরা সবাই দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির হিসাবেও চিনি |
দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির
রানী রাসমণির জন্ম হয় ২৬ সেপ্টেম্বর ১৭৯৩ সালে, বর্তমান উত্তর ২৪ পরগণার হালিশহরে অবস্থিত কোণা নামক একটা ছোট্ট গ্রামে | তাঁর বাবার নাম ছিলো হরেকৃষ্ণ দাস আর মায়ের নাম ছিলো রামপ্রিয়া দাসী |
জানা যায় হরেকৃষ্ণ দাস ছিলেন পেশায় একজন সাধারন দরিদ্র কৃষক ও গৃহনির্মাণকারী | ছোটবেলায় রাসমণির নাম তাঁর মা রামপ্রিয়া দাসীই প্রথম ভালোবেসে “রানী” রেখেছিলেন | পরে তাদের প্রতিবেশীদের দৌলতেই তাঁর নাম হয়ে যায় রানী রাসমণি |
রাসমণি কিন্তু অতি অল্প বয়সেই বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন | তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সেই কলকাতার যানবাজারের জমিদার রাজচন্দ্র দাসের সাথে বিয়ে করেন, সালটা ছিলো ১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দ |
এবার তোমার হয়তো এটা জানতে নিশ্চই ইচ্ছা করছে যে, কি করে রানী রাসমণির মত একটা গরিব পরিবারের মেয়ে, রাজচন্দ্র দাসের মতো এক ধনী ব্যবসায়ী তথা জমিদারকে বিয়ে করলো?
শোনা যায়, বাবু রাজচন্দ্র দাস নাকি ব্যবসায়িক কাজের সুত্রে একদিন ত্রিবেণীতে যাচ্ছিলেন, যেতে যেতে তিনি হঠাৎই পাশের গঙ্গার ঘাটে এক ১১ বছর বয়সই মেয়েকে দেখতে পান, যে সেখানে স্নান করতে এসেছিলো |
তাঁর রূপ ও মুখের লাবন্য দেখে সদ্য যৌবন প্রাপ্ত যুবক রাজচন্দ্র তাঁর প্রেমে পরে যান | সেইদিন রাজচন্দ্র আর ত্রিবেণীর উদ্দেশ্যে যেতে পারেননি এবং পুণরায় বাড়ি ফিরে আসেন |
এরপরেও তিনি আরো বেশ কিছুবার হালিশহরে, রাসমণির গ্রামে এসেছিলেন | সেখানে তিনি রাসমণির রূপ ও লাবন্য ছাড়াও তেজস্বীনী এবং দুয়ালু রূপের সাথেও পরিচিত হন | যারফলে তিনি রানীকে আরো গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেন |
অবশেষে রাজচন্দ্র দাস, তাঁর বাড়ির অনেক গুরুজনদের অমত থাকার পরেও রানীকে বিয়ে করে আনেন সেখানে | রাজচন্দ্র দাস ও রানী রাসমণির মোট ৫টা সন্তান হয়, যার মধ্যে তাদের প্রথম সন্তান জন্মের কিছু সময় পরেই মারা যায় | সে ছিলো তাদের প্রথম পুত্র সন্তান |
তাদের বাকি ৪টে সন্তানই ছিলো মেয়ে | যাদের নাম যথাক্রমে- পদ্মামনি,কুমারি,করুণা এবং জগদম্বা রাখা হয় |
রানী রাসমণি ও রাজচন্দ্র দুজনেই ভীষন দুয়ালু প্রকৃতির মানুষ ছিলেন | গরিব, দুঃখী, ভিক্ষুক কিংবা ক্ষুধার্ত মানুষ প্রত্যেকেরই রানী রাসমণি ও রাজচন্দ্র সেবা করে যেতেন মন প্রাণ উজার করে | কেউই অবহেলিত হতনা তাদের দয়া ও ভালোবাসা থেকে |
রাসমণি ও তাঁর স্বামী পরিবারের বেশিরভাগ সম্পদ সামাজিক কর্মকান্ড, ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানে ব্যয় করে দিতেন | এতে অবশ্য তাদের পরিবারের অনেকেই বিভিন্নভাবে অমত প্রকাশ করতেন কিন্তু তাতে তাঁরা দুজনে কোনোদিনই মানুষের সেবা বন্ধ করেননি |
জনসাধারণের জন্য স্নানঘাটের অসুবিধা দূর করতে তিনি বহু টাকা ব্যয় করে ফেলেন | তিনি ও তাঁর স্বামী রাজচন্দ্র, নিজের টাকায় কলকাতার বাবুঘাটকে বাঁধাতে সক্ষম হন | এরপর তারা তৈরী করেন আহিরীটোলা স্নানঘাট ও নিমতলা স্নানঘাটও |
কোলকাতার বাবুঘাট
এছাড়া বাবু রোড নির্মান সহ নিমতলা শ্মশান ঘাটে নিজের পারিবারিক জমির উপর পাকা বাড়ি নির্মানও করেন তারা |
রাসমণির উদ্যোগে তৈরী সবচেয়ে বিখ্যাত নিদর্শন হলো দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির, যেটা আমি লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি | কিন্তু আজ যে তুমি দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির দেখছ, সেটা তৈরীর পেছনেও রাসমণিকে সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষদের কাছ থেকে অনেক কথা শুনতে হয়েছিলো |
যেহেতু রাসমণির পিতৃ পক্ষের পরিবার সেইসময়কার সমাজ ব্যবস্থা অনুযায়ী নিম্নবর্ণের ছিলো তাই সমস্ত ব্রাহ্মণ সমাজ দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির নির্মানের কাজে প্রথমে বাঁধা সৃষ্টি করে | কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হয়নি, কারণ রাসমণি ব্রাহ্মণ সমাজের বাঁধা তোয়াক্কা না করে কালী মন্দির নির্মানের কাজ চালিয়ে যান |
পরে, দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের নির্মান কাজ শেষ হলে সেই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসাবে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসকে নিযুক্ত করা করা হয় |
এরপর আসি ১৮২০ সালে, বাংলায় তখন ভয়াবহ বন্যা | সেইসময় অনেক সাধারণ মানুষই বন্যার কবলে পরে নিজের বাড়ি-ঘর সহ সকল সম্পত্তি হারিয়েছিল | দয়াময়ী রানী রাসমণি প্রতিবারের মত সেইবারেও জনসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রচুর টাকা ব্যয় করেন |
জানা যায় সেই বছরেই রানী রাসমণির বাবা হরেকৃষ্ণ দাসও মারা যান | যেহেতু হরেকৃষ্ণের কোনো ছেলে সন্তান ছিলো না তাই সেহেতু রাসমণিই, মেয়ের কর্তব্য অনুসারে বাবার পরলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য গঙ্গার ঘাটে যান |
রানী রাসমণি ও রাজচন্দ্র দাসের বৈবাহিক জীবন বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি | রাজচন্দ্র দাস মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মারা যান | স্বামীর এই মৃত্যুতে রাসমণি ভীষনভাবে ভেঙ্গে পরেন | শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষটা যে এত কম বয়সে চলে যাবেন, তা তিনি কখনো ভাবতেও পারেননি |
আসলে যদি আজ আমরা ভালোভাবে বিচার করে দেখি, তাহলে আমরা এটা নিশ্চই বুঝে যাবো যে, রাসমণির এই বিশাল জনহিতকর কর্মকান্ডের পিছনে তাঁর স্বামী রাজচন্দ্রের অবদান ছিলো প্রচুর |
রাজচন্দ্র তাঁর স্ত্রীকে কোনদিনও জনহিতকর কাজ করার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই বাঁধা দেননি | সর্বদাই তাঁকে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি, পাশেও থেকেছেন একজন বন্ধুর মতো |
ঠিক একইভাবে রাসমণিও তাঁর স্বামীর প্রত্যেকটা পদক্ষেপে পাশে থেকেছেন | কোথাও ভুল করলে, স্বামীকে শুধরেও দিয়েছেন সদ পরামর্শের মাধ্যমে |
আগেকার দিনে স্বামীর কথাই ছিলো, প্রতেকটা স্ত্রীয়ের কাছে একদম শেষ কথা | স্বামীকে পরামর্শ দেওয়ার ভাবনাও ছিলো, একজন স্ত্রীয়ের কাছে বড় বিপদের |
কিন্তু রাজচন্দ্র দাস ছিলেন একদমই অন্য স্বভাবের মানুষ | তিনি আধুনিক ধ্যান ধারনায় বিশ্বাসী ছিলেন | তিনি নারীদের সন্মান দেওয়ার পাশাপাশি তাদের শ্রদ্ধাও করতেন ভীষনভাবে | তাই তিনি তাঁর স্ত্রীর পরামর্শকে শুনতেন এবং মেনেও চলতেন প্রয়োজন মতো |
এবার তবে জানা যাক রানী রাসমণির জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার সম্পর্কে:
১. জগন্নাথ দেবের পুজো উপলক্ষে একবার রানী রাসমণি, তাঁর পরিবার ও দাস-দাসীদের নিয়ে জগন্নাথ ধামের উদ্দেশ্যে (পুরী) যাচ্ছিলেন | যেতে যেতে তিনি লক্ষ্য করেন যে, সেখানকার রাস্তা ভীষনই খারাপ | বাকি তীর্থ যাত্রীদের খুব কষ্ট হচ্ছে সেই পথ ধরে তীর্থের উদ্দেশ্যে যেতে | সেই দেখে রানীর মন ভীষন দুঃখে ভরে ওঠে |
পরে তিনি তাদের সুবিধার কথা চিন্তা করে সমস্ত রাস্তা সংস্কার করে দেন | কিন্তু এখানেই তিনি থেমে থাকেননি, তখনকার সময় অনুযায়ী প্রায় ৬০ হাজার টাকা ব্যয় করে তিনি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা এই তিন বিগ্রহের জন্য হীরক খচিত তিনটি মুকুটও তৈরি করে দেন |
২. সারা ভারতে তখন ব্রিটিশ শাসন, বাংলার ইংরেজরা গঙ্গা নদীতে জেলেদের মাছ ধরার ক্ষেত্রে চড়া শুল্ক আদায় করে চলেছে | বাংলার দরিদ্র জেলেদের অবস্থা প্রায় বিপন্ন | অবশেষে রানী রাসমণি এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন এবং ইংরেজ সরকারকে চাপ দেন শুল্ক তোলার জন্য |
রাসমণির জেদের আগে ইংরেজ সরকারকেও হার মানতেই হয় | তারপর ইংরেজ সরকার জেলেদের গঙ্গায় মাছ ধরার বিনিময়ে শুল্ক নেওয়া বন্ধ করে অবশেষে | এরপর জেলেদের মাছ ধরার সুবিধার্থে গঙ্গায় চলাচলকারী কয়েকটি স্টিমার সার্ভিস বন্ধ করতেও তিনি সক্ষম হন | যারজন্য তাঁকে প্রচুর টাকাও ব্যয় করতে হয়েছিলো |
৩. তুমি আশা করি এটা জানোই যে, ব্রিটিশ আমলে ভারতীয়দের দিয়ে নীলচাষ করানো হত | একবার এক ইংরেজ নীলকর সাহেব বর্তমান বাংলাদেশের মকিমপুর অঞ্চলের মানুষজনদের, জোর করে নীলচাষ করানোর জন্য ভীষন অত্যাচার করতে থাকে |
এই কথা জানতে পেরে রানী রাসমণি ছুটে যান সেখানকার মানুষদের সাহায্য করতে | পুণরায় তাঁরই হস্তক্ষেপে সবকিছু বন্ধ হয়ে যায় আগের মতো | তিনি প্রজাদের উন্নতির জন্য প্রায় এক লক্ষ টাকা খরচ করে একটা খাল খনন করে দেন যারফলে মধুমতী নদীর সঙ্গে গঙ্গার সংযোগ স্থাপন হয় |
এরপর পর পরই তিনি কলকাতায় এসে বেলেঘাটা এবং ভবানীপুরে বাজার স্থাপন করেন আর কালিঘাট নির্মান করেন |
রানী রাসমণির শ্বেত মূর্তি
রানী রাসমণি ছিলেন একজন দৃঢ় স্বভাবের নারী | তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, সমসাময়িক বাকি নারীদের থেকে অনেক বেশি পরিনত ছিলো | তাঁর সবচেয়ে বড় গুন ছিলো, তিনি যেই কাজকে একবার সঠিক বলে মনে করতেন, সেই কাজকে তিনি সম্পূর্ণ করেই ছাড়তেন যতই বাঁধা বিপত্তি আসুক না কেন |
তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, মানুষের সেবা কীভাবে ভক্তিপূর্বক করতে হয় | তিনি কোনদিনও জনসাধারণের থেকে তাঁর সেবার বিনিময়ে কিচ্ছু পাওয়ার আশা করেননি বরং তাদেরই সর্বদা উপহার হিসাবে দিয়ে গেছেন বিভিন্ন জিনিস |
তাঁর মহান কর্মই তাঁকে আজ করে তুলেছে সকলের কাছে চিরস্মরনীয় |
অর্থের সঠিক ব্যবহার, তাঁর কাছ থেকেই আমাদের প্রতেক্যের শেখা উচিত | কারন বর্তমানে এমন অনেক মানুষই আছে, যারা টাকা তো উপার্জন করছে প্রচুর কিন্তু সেটা শুধু নিজেদেরই জন্য |
অসহায় মানুষদের সাহায্যের কথা ভাবা, তাদের কাছে শুধু সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয় | যদি সেইসব মানুষরা আজ রানী রাসমণির মতো মানুষদের সেবা করতে শুরু করে, তাহলে ভারতে একসময় কেউ আর দরিদ্র, ক্ষুধার্ত ও অসহায় থাকবে না |
অবশেষে ১৮৬১ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারী, প্রায় ৬৮ বছর বয়সে এই মহান মহিয়সী নারীর জীবনাবসান হয় |