Thursday 26 March 2020

নৌবিদ্রোহের কারণ ও গুরুত্ব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও

বিদ্রোহ :
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বশেষ আন্দোলন হল নৌবিদ্রোহ। ভারতছাড়ো আন্দোলন, আজাদহিন্দ বাহিনীর সংগ্রাম ইত্যাদির চাপে ব্রিটিশ সরকারের যখন নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম ঠিক তখনই নৌবিদ্রোহ (১৯৪৬) যেন ভারতের ব্রিটিশ শাসনের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়েছিল। ড. সুমিত সরকারের মতে, এই বিদ্রোহ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বীরোচিত সংগ্রাম।

বিদ্রোহের কারণ বা পটভূমি :
এই বিদ্রোহের পটভূমি বিশ্লেষণ করলে এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ নজরে পড়ে। কারণগুলি হল --
বেতন বৈষম্য : ভারতীয় নৌবাহিনীতে প্রবল বর্ণ বৈষম্য ছিল। বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেও ভারতীয় নাবিকরা ইংরেজদের মত বেতন পান নি।
বর্ণবৈষম্য : ভারতীয় নাবিকরা ইংরেজ ও শ্বেতাঙ্গ অফিসারদের দ্বারা সর্বদাই লাঞ্ছিত হতেন। জাতি ও বর্ণগত কারণে তাঁরা এই লাঞ্ছনার শিকার হতেন।
নিম্ন মানের খাদ্য : ভারতীয় নৌসেনারা ইয়রোপীয়দের তুলনায় নিম্নমানের ও অল্প পরিমাণে খাবার পেতেন।
পদোন্নতির অভাব : যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় নৌসেনারা পদোন্নতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হাত।
বিপজ্জনক কেন্দ্রে নিয়োগ : অনিচ্ছা সত্বেও ভারতীয় নৌসেনাদের বিপজ্জনক অঞ্চলে নিয়োগ করা হত।
সেনা ছাঁটাই : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রচুর নৌসেনা নিয়োগ করা হয়। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তাদের বিনা কারণে বরখাস্ত করে।
বিশ্ব-পরিস্থিতির জ্ঞান : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয় নৌসেনারা বিশ্ব-পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞান করে। ফলে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাদেরও ক্ষোভ জন্মায়।
অভ্যন্তরীন ঘটনাবলি : দেশের অভ্যন্তরে ভারত ছাড়ো আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, পুলিশ ও বিমান বাহিনীর ধর্মঘট ইত্যাদি ঘটনা নাবিকদের গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
আজাদ হিন্দ সেনার বিচার : সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সংগ্রাম ভারতীয় নৌসেনাদের খুবই অনুপ্রাণিত করে। এই পরিস্থিতিতে পরাজিত সেনাদের বিচার শুরু হলে দেশের জনগণের সঙ্গে তাঁরাও ক্ষোভে ফেটে পড়ে
এই সমস্ত কারণে ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ( ১৮-২৩) ভারতীয় নৌসেনারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে যা নৌবিদ্রোহ নামে পরিচিত।
বিদ্রোহের প্রসার :
বোম্বাইয়ের 'তলোয়ার' নামক জাহাজে প্রথম নৌবিদ্রোহ শুরু হয়। ক্রমে আরও ২২টি জাহাজে ছড়িয়ে পড়ে। এর দ্রুত তা করাচি, কলকাতা, মাদ্রাজ, কোচিন, জামনগর, চট্টগ্রাম, বিশাখাপত্তনম, আন্দামান প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহ পরিচালনার জন্য 'কেন্দ্রীয় ধর্মঘট কমিটি' গঠিত হয়। দেশের ছাত্র সমাজ ও সাধারণ মানুষ বিদ্রোহীদের সমর্থন করে ধর্মঘটে সামিল হয়। বিভিন্ন সংঘর্ষে প্রায় ৩০০ লোক নিহত এবং ২ হাজার আহত হয়।

ব্যর্থতার কারণ :
অল্প সময়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করলেও এই বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে ছিল। কারণ --
জাতীয় নেতাদের বিরোধিতা : কংগ্রেসের অনেক নেতা এই বিদ্রোহকে সমর্থন করে নি। নেহেরু, সর্দার প্যাটেল, গান্ধিজি প্রমুখ নেতা বিদ্রোহীদের সমালোচনা করেন। সম্ভবত তাঁরা জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব হাতছাড়া হওয়ার ভয় পাচ্ছিলেন।
বিমান হানার ভয় : আকাশ থেকে বিমান হানার ভয় ও জাতীয় নেতাদের চাপ আন্দোলনকে দুর্বল করে দে।
বল্লভভাই এর মধ্যস্ততা : সর্দার প্যাটেল সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব আনলে বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করে।

বিদ্রোহের গুরুত্ব :
এভাবে অনেক আশা জাগিয়েও শেষ পর্যন্ত নৌবিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। তবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক এর গুরুত্বকে সম্মানের সঙ্গে তুলে ধরেছেন।
ব্রিটিশ শাসনের মৃত্যুঘন্টা : শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহ ভারতে ব্রিটিশ সরকারের মৃত্যু ঘন্টা বাজিয়ে দে।
ব্রিটিশ ভীতির অবসান: নৌসেনাদের বিদ্রোহ সাধারণ মানুষের মনে ব্রিটিশ ভীতি দূর করেছিল।
হিন্দু-মুসলিম ঐক্য : হিন্দু-মুসলিম নাবিক, এমনকি সাধারণ মানুষও এই সময় সাম্প্রদায়িক ঐক্যের পরিচয় দিয়েছিল।
মন্ত্রী মিশনের আগমন : ঐতিহাসিক রজনী পামদত্তের মতে, নৌবিদ্রোহের ফলে ইংরেজ সরকার কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের সঙ্গে আলোচনা করতে বিদ্রোহ শুরুর পরের দিনই মন্ত্রী মিশনকে ভারতে পাঠানর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
ভারত ত্যাগের ভাবনা : ভারতে এমন আর একটি বিদ্রোহ শুরু হলে তার পরিণাম যে ভয়ংকর হবে একথা বুঝতে পারে। ফলে শীঘ্রই ভারত ত্যাগের কথা ভাবতে শুরু করে।

মূল্যায়ন :
অমলেশ ত্রিপাঠি, সুচেতা মহাজন প্রমুখ ঐতিহাসিক বলেছেন, এই বিদ্রোহ গ্রামাঞ্চলে ও সাধারণ জনমানসে বিশেষ ছাপ ফেলতে পারে নি। তা সত্বেও একথা নিশ্চিত যে এই বিদ্রোহ ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারকে ভাবতে বাধ্য করেছিল। 
Comment

Class XI Political Science

Class XII Political Science

Class 12 Bangla Books Question& Answers