মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা কবে, কিভাবে আবিষ্কার হয়েছিল ?.
সাধারণ ভাবে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন শুধুমাত্র একজনের দ্বারা ঘটেনা । নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অনেকের হাতে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি গড়ে ওঠে । মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা সম্পর্কে আমরা একই কথা বলতে পারি । জাইলোগ্রাফী (Block Printing) অষ্টম শতকের গোঁড়ার দিকে চীনদেশে প্রথম এসেছিল । মুদ্রাকররা যে ভাষ্য বা ছবি ছাপাতে চাইতেন তা প্রথমে একটা কাঠের ফলকের উপর উলটো করে খোদাই করে কালি মাখিয়ে কাগজের উপর ছেপে দিতেন । ইতিমধ্যে কাগজ তৈরির রীতিনীতি চিন দেশ থেকে আরবদের মাধ্যমে ইউরোপে চালু হয়ে যায় ।
সচল ধাতুর হরফ ওয়ালা মুদ্রণযন্ত্র ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জার্মানির মেইনজ শহরে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে । মুদ্রণযন্ত্র আত্মপ্রকাশ করেছিল এক ছোট প্রাদেশিক শহরে, যার জনসংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার । এই যন্ত্র উদ্ভাবনের সাথে তিনজন মানুষের নাম জড়িয়ে আছে । তাঁরা হলেন যোহান গুটেনবার্গ, যোহান ফস্টে ও পিটার শোফার ।
গুটেনবার্গ, ফস্টে ও শোফার যে মুদ্রণযন্ত্র চালু করেছিলেন তাতে এক বিশেষ ধরণের কালি লাগত । ছবি আঁকার তেল রঙের তেল মিশিয়ে এই বিশেষ ধরণের কালি তৈরি হত । এরসাথে ব্যবহার করা হত কাগজে কালি ছাপ লাগাবার বিশেষ যন্ত্র ও ধাতুর হরফ । ধাতুর হরফ তৈরির কৌশল এসেছিল ধাতুর নানা রকম সূক্ষ্ম কাজ কর্মের বহুকালের পুরনো ঐতিহ্য থেকে ।
ছাপাখানাতে প্রথম যে বইটি ছাপা হয়েছিল সেটি হল ল্যাটিন ভাষায় মুদ্রিত বাইবেল । তার হরফের সৌন্দর্য, হরফ সাজাবার আর ছাপার মুনশিয়ানা প্রায় তাক লাগিয়ে দেবার মত নিখুঁত ছিল । এই বই ১৪৫৫ সালে প্রথম ছাপা হয়েছিল । এর দুবছর পর ফস্টে ও শোফার বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের স্তোত্র সার প্রকাশ করেন । এই বইটি ছিল ইউরোপে প্রথম স্বাক্ষরিত ও তারিখ দেওয়া বই । পরবর্তী তিনশো বছর এভাবেই চলতে থাকে ।
প্রথম দিকের মুদ্রিত বই গুলি ছিল হুবহু হাতে লেখা পুঁথির মত । সে সময়ের মুদ্রাকররা কম দামে তাদের খদ্দেরের হাতে বই তুলে দেওয়ার কাজ করতেন । মেইনজ শহরের ব্যবসায়ী, আইনজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, সরকারী কর্মচারী ইত্যাদি মানুষদের মধ্যে নতুন বইয়ের চাহিদা ছিল উল্লেখযোগ্য । ব্যবসা-বাণিজ্য চালানো, সরকারী দপ্তরের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ, সমাজে মেলামেশা, জীবিকা নির্বাহ করার জন্য এই সব মানুষদের লেখাপড়া করতে হত । এছাড়াও স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে বইয়ের চাহিদা ছিল অনেক । মানুষেরা নিজেদের দরকারে ল্যাটিন ও নানা ভাষায় বই কিনতেন ।
মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা আবিষ্কারের আগে লেখাপড়া হত প্রাচীন ও সমসাময়িক পণ্ডিতদের লেখা নকল করে । এরফলে দুধরণের সমস্যা দেখা যেত । নকল করার কাজ হত খুব ধীর গতিতে, এবং তাতে প্রচুর ভুলভ্রান্তি দেখা যেত । কিন্তু, মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা আবিষ্কারের ফলে এই দুই সমস্যার সমাধান সম্ভব হল । নির্ভুল রচনা জ্ঞান ও বিদ্যাচর্চার পরিধির বিস্তার ঘটাল । কোপারনিকাস, ইরাসমাসের লেখা ইউরোপের পণ্ডিত ও জ্ঞানী মানুষদের কাছে ছড়িয়ে পড়ল । দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে ধর্ম সংস্কারের ধ্যান ধারণা ।
মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা আবিষ্কারের গুরুত্ব সুপ্রাচীন কালে হাতে লেখা আর আধুনিক কম্পিউটার আবিষ্কারের সমতুল্য । এর পাশাপাশি নিষিদ্ধ বইয়ের সংখ্যা বাড়তে লাগল । ১৫৬০ সালের মধ্যে পশ্চিম ইউরোপে বইয়ের উপর সেন্সর প্রথা চালু হয় ।
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হয় ১৫৫৬ সালে, গোয়ায় । ১৫৬৭ সালে গোয়ার ছাপাখানা থেকে এ অঞ্চলের প্রথম বইটি ছেপে বের হয় । খ্রিস্টান মিশনারিরা তাঁদের ধর্মীয় ভাবনা বিভিন্ন প্রকাশনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতেন । বাংলায় প্রথম ছাপাখানা স্থাপিত হয় ১৭৭৭ সালে । জেমস অগাস্টাস হিকি ১৭৭৭ সালে ‘Bengal Gazette’ নামের সাময়িকপত্র প্রকাশ করেন । ১৭৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলী থেকে প্রকাশিত ‘A Grammar of the Bengal Language’ গ্রন্থে বাংলা হরফের প্রথম মুদ্রিত উপস্থিতি দেখা যায় ।
প্রথম এই বই প্রকাশের কৃতিত্ব দেখান ইংরেজ ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হালেদ (১৭৫১-১৮৩০)। বাংলা হরফ নির্মাণকারী তথা বাংলা ছাপাখানা ও মুদ্রণশিল্পের জনক হিসেবে যাঁকে আমরা জানি তিনি হলেন ব্রিটিশ সিভিলিয়ান স্যার চার্লস উইলকিন্স (১৭৫০-১৮৩৬)। হরফ নির্মাণে উইলকিন্সের সহযোগী ছিলেন বাঙালি খোদাইশিল্পী পঞ্চানন কর্মকার । উল্লেখ্য, উনিশ শতকের শেষ অর্ধ শতাব্দী ধরে বাংলাদেশের সর্বত্র ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে । এসব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিলেন বিভিন্ন এলাকার রাজ-জমিদাররা । ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব বাংলায় যে মুদ্রণযন্ত্র ছিল, তা নিতান্তই ক্ষুদ্রাকৃতির । তখন বেশির ভাগ প্রকাশনা কলকাতা থেকে মুদ্রিত হতো । দেশভাগের পর কলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তান বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের প্রথম কৃতিত্ব দেখান মওলানা আকরাম খাঁ ।
আমাদের লেখা আপনার কেমন লাগছে বা আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নিচে কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্ট টি পৌঁছেদিতে অনুগ্রহ করে শেয়ার করুণ । জানা অজানা ও ইতিহাস বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে নিচে জানা অজানা ও ইতিহাস লেখাটির উপর ক্লিক করুণ । পুরো পোস্ট টি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।