ইউরোপীয় শিল্পোদ্যোগ
ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে ইউরোপীয়দের উদ্যোগে সর্বপ্রথম শিল্পের বিকাশ শুরু। মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭) পর থেকে ভারতে শিল্পায়নের অগ্রগতি শুরু হয়। এই শিল্প বিকাশের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এগুলি হল –
1) ভারতীয় উদ্যোগের বিরোধিতা। ইউরোপীয় শিল্পপতিরা ভারতীয় শিল্পোদ্যোগের বিরোধিতা করতেন। কারণ, তারা মনে করতেন ভারতীয় উদ্যোগের ফলে তাদের ভারতীয় বাজার ও কাঁচামাল হাতছাড়া হবে।
2) ভোগ্যপণ্য প্রস্তুতি। ভারতে ভারী বা মূলধন সৃষ্টিকারী শিল্প (যেমন – যন্ত্রপাতি, লৌহ-ইস্পাত ইত্যাদি) গড়ে তুলতে চাননি। মূলতঃ ভোগ্যপণ্যের সঙ্গে যুক্ত শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ করতেন।
ইউরোপীয় শিল্পবিকাশের কারণ।
ভারতে ইউরোপীয় শিল্পপতিদের শিল্পোদ্যোগ গ্রহণের বিভিন্ন কারণ ছিল। সেগুলি হল –
1) সস্তা কাঁচামাল। ভারত ছিল মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। তাই এখানে সস্তায় প্রচুর শিল্পের উপযোগী কাঁচামাল পাওয়া যেত।
2) সুলভ শ্রমিক। প্রচুর জনসংখ্যার কারণে এখানে সামান্য মজুরিতে প্রচুর শ্রমিক পাওয়া যেত। ফলে এদেশে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় কম হত।
3) পুঁজির যোগান। শিল্প স্থাপনের জন্য প্রচুর মূলধন প্রয়োজন হয়। ব্রটিশ শিল্পপতিরা ভারতে ভারতে শিল্পের জন্য সহজ সুদে ও শর্তে ঋণ পেতেন। ভারতীয়রা এরূপ সুবিধা পেতেন না।
4) পণ্যের চাহিদা। ভারত ও তার প্রতিবেশী দেশগুলিতে ব্রিটিশ পণ্যের বিপুল চাহিদা ছিল। তাই তারা এখনে শিল্প প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ দেখায়।
5) বিপুল লাভের আশা। ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা উপলব্ধি করেছিলেন, ইংল্যন্ডের মাটিতে শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ কর ভারতের মত এত সহজে এত বেশি লাভ করা সম্ভব নয়।
6) সহায়তা লাভ। ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা ভারতে শিল্পপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি আনা, বিদেশি বীমা কোম্পানি, ম্যানেজিং এজেন্সি, সরকারি কর্মচারিদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রভৃতি সুবিধা লাভ করত।
উপরোক্ত কারণে কলকাতাকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয়দের উদ্যোগে শিল্পের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। ১৯০৫ সালে ভারতে মোট শিল্প-কারখানার সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬৮৮টি।
ভারতীয় শিল্পোদ্যোগের সমস্যা।
অপরদিকে, এই পর্বে ভারতীয় উদ্যোগে শিল্পের তেমন অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি। এর কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ড. অমিয় বাগচি বলেছেন, বিদেশি ঔপনিবেশিক শাসননীতিই ভারতীয় উদ্যোগে শিল্প বিকাশের পথে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল। এই বাধার কারণগুলি হল –
i. লাইসেন্স সমস্যা। শিল্প স্থাপনের জন্য সরকারি লাইসেন্স পেতে ভারতীয় শিল্পোদ্যোগীদের বিভিন্ন রকম হয়রানির শিকার হতে হত।
ii. মূলধণের স্বল্পতা। ডি আর গ্যাডগিলের মতে, ভারতীয় শিল্পপতিরা মূলধনের স্বল্পতায় ভুগছিল। কারণ, তারা ইউরোপীয়দের মত সহজে ব্যাংক ঋণ পেতেন না।
iii. রেল মাশুলে বৈষম্য। বিভিন্ন দ্রব্য পরিবহণের জন্য রেল মাশুলে দেশি ও বিদেশি পণ্যের ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হত। ফলে ভারতীয় পুঁজিপতিরা অনুৎসাহিত হত।
iv. শুল্ক বৈষম্য। বিলিতি পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমিয়ে ও দেশীয় পণ্যের ওপর অত্যধিক উৎপাদক শুল্ক চাপিয়ে ভারতীয় শিল্পের উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিন।
v. যন্ত্রবিদের অভাব। উপযুক্ত প্রশিক্ষিত যন্ত্রবিদের অভাব ভারতীয় শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল।
vi. সহযোগিতার অভাব। ইউরোপীয় শিল্পোদ্যোগীরা সরকারের সহযোগীতা যেভাবে পেতেন ভারতীয়রা তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পেতেন না।
vii. বিনিয়োগে অণীহা। শিল্পে বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকে। ভারতীয়রা অনেক ক্ষত্রেই এই ঝুঁকি না নিয়ে নিশ্চিত আয়ের জন্য জমিদারি কেনায় বেশি আগ্রহ দেখাতেন।
উপসংহার।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা ভাততে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে যে অনুকূল পরিবেশ ও সরকারি আনুকূল্য পেয়েছিল তা ভারতীয়রা পায়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশীয় শিল্পপতিরা সরকারি প্রতিহিংসার শিকার হত। বিনয় ঘোষের মতে, বর্ণবৈষম্যজাত সামাজিক অবজ্ঞা ও উপেক্ষা আমাদের দেশীয় বণিকগোষ্ঠীকে শক্তিশালি আধুনিক পুঁজিপতি গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হতে দেয়নি।
ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে ইউরোপীয়দের উদ্যোগে সর্বপ্রথম শিল্পের বিকাশ শুরু। মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭) পর থেকে ভারতে শিল্পায়নের অগ্রগতি শুরু হয়। এই শিল্প বিকাশের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এগুলি হল –
1) ভারতীয় উদ্যোগের বিরোধিতা। ইউরোপীয় শিল্পপতিরা ভারতীয় শিল্পোদ্যোগের বিরোধিতা করতেন। কারণ, তারা মনে করতেন ভারতীয় উদ্যোগের ফলে তাদের ভারতীয় বাজার ও কাঁচামাল হাতছাড়া হবে।
2) ভোগ্যপণ্য প্রস্তুতি। ভারতে ভারী বা মূলধন সৃষ্টিকারী শিল্প (যেমন – যন্ত্রপাতি, লৌহ-ইস্পাত ইত্যাদি) গড়ে তুলতে চাননি। মূলতঃ ভোগ্যপণ্যের সঙ্গে যুক্ত শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ করতেন।
ইউরোপীয় শিল্পবিকাশের কারণ।
ভারতে ইউরোপীয় শিল্পপতিদের শিল্পোদ্যোগ গ্রহণের বিভিন্ন কারণ ছিল। সেগুলি হল –
1) সস্তা কাঁচামাল। ভারত ছিল মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। তাই এখানে সস্তায় প্রচুর শিল্পের উপযোগী কাঁচামাল পাওয়া যেত।
2) সুলভ শ্রমিক। প্রচুর জনসংখ্যার কারণে এখানে সামান্য মজুরিতে প্রচুর শ্রমিক পাওয়া যেত। ফলে এদেশে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় কম হত।
3) পুঁজির যোগান। শিল্প স্থাপনের জন্য প্রচুর মূলধন প্রয়োজন হয়। ব্রটিশ শিল্পপতিরা ভারতে ভারতে শিল্পের জন্য সহজ সুদে ও শর্তে ঋণ পেতেন। ভারতীয়রা এরূপ সুবিধা পেতেন না।
4) পণ্যের চাহিদা। ভারত ও তার প্রতিবেশী দেশগুলিতে ব্রিটিশ পণ্যের বিপুল চাহিদা ছিল। তাই তারা এখনে শিল্প প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ দেখায়।
5) বিপুল লাভের আশা। ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা উপলব্ধি করেছিলেন, ইংল্যন্ডের মাটিতে শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ কর ভারতের মত এত সহজে এত বেশি লাভ করা সম্ভব নয়।
6) সহায়তা লাভ। ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা ভারতে শিল্পপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি আনা, বিদেশি বীমা কোম্পানি, ম্যানেজিং এজেন্সি, সরকারি কর্মচারিদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রভৃতি সুবিধা লাভ করত।
উপরোক্ত কারণে কলকাতাকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয়দের উদ্যোগে শিল্পের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। ১৯০৫ সালে ভারতে মোট শিল্প-কারখানার সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬৮৮টি।
ভারতীয় শিল্পোদ্যোগের সমস্যা।
অপরদিকে, এই পর্বে ভারতীয় উদ্যোগে শিল্পের তেমন অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি। এর কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ড. অমিয় বাগচি বলেছেন, বিদেশি ঔপনিবেশিক শাসননীতিই ভারতীয় উদ্যোগে শিল্প বিকাশের পথে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল। এই বাধার কারণগুলি হল –
i. লাইসেন্স সমস্যা। শিল্প স্থাপনের জন্য সরকারি লাইসেন্স পেতে ভারতীয় শিল্পোদ্যোগীদের বিভিন্ন রকম হয়রানির শিকার হতে হত।
ii. মূলধণের স্বল্পতা। ডি আর গ্যাডগিলের মতে, ভারতীয় শিল্পপতিরা মূলধনের স্বল্পতায় ভুগছিল। কারণ, তারা ইউরোপীয়দের মত সহজে ব্যাংক ঋণ পেতেন না।
iii. রেল মাশুলে বৈষম্য। বিভিন্ন দ্রব্য পরিবহণের জন্য রেল মাশুলে দেশি ও বিদেশি পণ্যের ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হত। ফলে ভারতীয় পুঁজিপতিরা অনুৎসাহিত হত।
iv. শুল্ক বৈষম্য। বিলিতি পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমিয়ে ও দেশীয় পণ্যের ওপর অত্যধিক উৎপাদক শুল্ক চাপিয়ে ভারতীয় শিল্পের উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিন।
v. যন্ত্রবিদের অভাব। উপযুক্ত প্রশিক্ষিত যন্ত্রবিদের অভাব ভারতীয় শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল।
vi. সহযোগিতার অভাব। ইউরোপীয় শিল্পোদ্যোগীরা সরকারের সহযোগীতা যেভাবে পেতেন ভারতীয়রা তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পেতেন না।
vii. বিনিয়োগে অণীহা। শিল্পে বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকে। ভারতীয়রা অনেক ক্ষত্রেই এই ঝুঁকি না নিয়ে নিশ্চিত আয়ের জন্য জমিদারি কেনায় বেশি আগ্রহ দেখাতেন।
উপসংহার।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা ভাততে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে যে অনুকূল পরিবেশ ও সরকারি আনুকূল্য পেয়েছিল তা ভারতীয়রা পায়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশীয় শিল্পপতিরা সরকারি প্রতিহিংসার শিকার হত। বিনয় ঘোষের মতে, বর্ণবৈষম্যজাত সামাজিক অবজ্ঞা ও উপেক্ষা আমাদের দেশীয় বণিকগোষ্ঠীকে শক্তিশালি আধুনিক পুঁজিপতি গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হতে দেয়নি।