Thursday 26 March 2020

ঊনিশ শতকে দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ভারতে কিভাবে বিভিন্ন শিল্পের অগ্রগতি ঘটেছে দেখাও।

ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর ব্রিটিশ সরকার ভারতকে একটি কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে। ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের পর পরিস্থিতি পাল্টায়। বিলম্ব হলেও এই সময় ইউরোপীয় ও ভারতীয় উদ্যোগে শুরু হয় নির্দিষ্ট কিছু শিল্পের বিকাশ।
ইউরোপীয় শিল্পোদ্যোগ
বৈশিষ্ট্য
ইউরোপীয় উদ্যোগে ভারতে শিল্প- বিকাশের কয়েকটি বিশেষত্ব লক্ষ্য করা যায়। যেমন –
A.  ভারতীয় উদ্যোগের বিরোধিতা। কারণ, ইংল্যান্ড ও ভারতীয় ইংরেজ শিল্পপতিরা মনে করতেন যে, ভারতীয় উদ্যোগে শিল্প গড়ে উঠলে ভারতের বাজার ও কাঁচামাল তাদের হাতছাড়া হবে।
B.  ভোগ্যপণ্য প্রস্তুতি। ভারী বা মূলধন সৃষ্টিকারী শিল্পের পরিবর্তে ইউরোপীয়রা মূলত ভোগ্যপণ্যের সঙ্গে যুক্ত শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ করতেন।
শিল্প বিকাশের কারণ
ভারেত ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের শিল্পোদ্যোগের পিছনে কয়েকটি কারণ ছিল –
1)  উৎপাদন ব্যয় কম। কারণ, সামান্য মজুরিতে প্রচুর শ্রমিক পাওয়া যেত।
2)   সস্তায় কাঁচামাল। কারণ, এখানে খুব সস্তায় প্রচুর কাঁচামাল পাওয়া যেত।
3)  বিপুল চাহিদা। কারণ, ভারত ও প্রতিবেশী দেশে শিল্পপণ্যের বিপুল চাহিদা ছিল।
4)   বেশি লাভ। ইংল্যান্ডের চেয়ে ভারতে পুঁজি বিনিয়োগ অধিক লাভজনক চিল।
5)  সরকারি সাহায্য। ইংরেজ শিল্পপতিরা ভারতে শিল্পোস্থাপনের ক্ষেত্রে প্রচুর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করত।
6)   ঋণের সুবিধা। ব্রিটিশ শিল্পপতিরা ভারতে শিল্পস্থাপনের ক্ষেত্রে সহজ সুদে ঋণ পেতেন।
বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ
ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের উদ্যোগে ভারতে যেসব শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল সেগুলি হল –
v রেলপথ। ভারতে পুঁজি বিনিয়োগের সবচেয়ে লাভজনক ক্ষেত্র ছিল রেল। বিপুল লাভের সুযোগ এবং গ্যারান্টি ব্যবস্থার নিশ্চয়তা থাকায় তারা রেলে প্রচুর মূলধন বিনিয়োগ করে। ১৯০০ সালের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার রেলপথ নির্মিত হয়।
v সুতিবস্ত্র। ১৮১৮ সালে ইউরোপীয় উদ্যোগে হাওড়ায় ‘বাউড়িয়া কটন মিল’ প্রতিষ্ঠিত হয়। দুজন ফরাসি ১৮৩০ সালে পন্ডিচেরিতে এবং জেমস ল্যান্ডন (ইংরেজ) ১৮৫৩ সালে ব্রোচে সুতোকাটা কল স্থাপন করেন। ১৯২১ সালের মধ্যে ইউরোপীয় উদ্যোগে ৯ টি কাপড়ের মিল গড়ে ওঠে।
v চা ও কফি শিল্প। বাগিচা শিল্পে ইউরোপীয় শিল্পপতিদের প্রাধান্য ছিল। ১৮২৩ সালে রবার্ট ব্রুস আসামের জঙ্গলে সর্বপ্রথম চা গাছ আবিষ্কার করেন। ১৮৩৪ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক ‘চা কমিটি’ গঠন করেন। এই কমিটির তথ্যের ভিত্তিতে চা শিল্প গড়ে ওঠে।  কিছু ইংরেজ বণিক ১৮৩৯ সালে ‘আসাম টি কোম্পানি’ গঠন করেন। ক্রমে আসাম, বাংলা, পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ ও দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি অঞ্চলে চা শিল্পের প্রসার ঘটে। ১৯০২ সালে ভারতে মোট চা বাগিচার সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০২টি। ১৮২৩ সালে বাংলায় সর্বপ্রথম কফি চাষ শুরু হয়। তবে দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি অঞ্চলে কফি চাষ লাভজনক হয়ে ওঠে।
v নীল ও চিনি শিল্প। ইউরোপীয় উদ্যোগে ভারতে নীল, আখ প্রভৃতি আবাদভিত্তিক শিল্পের বিকাশ ঘটে। ১৮৩৩ সালে সনদ আইনে নীলকররা জমির ওপর মালিকনাস্বত্ব লাভ করলে নীলচাষ ব্যপকতা লাভ করে। চিনি শিল্পেও ইউরোপীয়রা প্রচুর মূলধন বিনিয়োগ করে।
v পাটশিল্প। ১৮৫৫ সালে জর্জ অকল্যান্ড রিষড়ায় সর্বপ্রথম পাটকল স্থাপন করেন। গঙ্গার দুই তিরে বেশ কিছু পাট কল গড়ে ওঠে। ১৯১২-১৩ সালে ভারতে পাটকলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৪টি। এগুলিতে প্রায় ২লক্ষ ১৬হাজার কর্মী কাজ করত।
v লৌহ-ইস্পাত ও জাহাজ শিল্প। ইউরোপীয় পুঁজিপতিদের উদ্যোগে এই শিল্পের তেমন প্রসার ঘটেনি। ১৮২০ সালে মাদ্রাজে প্রথম লোহা ও ইস্পাত শিল্প গড়ে ওঠে। এরপর ব্রিটিশ উদ্যোগে ‘বেঙ্গল আয়রন ওয়ার্কারস কোম্পানি’(১৮৭৪), বেঙ্গল আয়রণ অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি’ (১৮৮৯), ইন্ডিয়ান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি (১৯১৮) গড়ে ওঠে।
v কয়লা শিল্প। ১৮১৪ সালে রানিগঞ্জে সর্বপ্রথম কয়লাখনি আবিস্কৃত হয়। তবে রেলপথ স্থাপনের পর কয়লা শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটে। ১৯০৯ সালের মধ্যে কেবল বাংলাতেই ১১৯টি কয়লা উত্তোলক কোম্পানি গড়ে ওঠে।
v সেচের যন্ত্রপাতি নির্মান শিল্প। ভারতে ব্রিটিশ পুঁজি বিনিয়োগের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্ষেত্র ছিল সেচের যন্ত্রপাতি নির্মান শিল্প। সিন্ধু, পাঞ্জাব প্রভৃতি অঞ্চলে সেচের যন্ত্রপাতি স্থাপনের জন্য ব্রিটিশ বিনিয়োগ করা হয়।
v ইঞ্জিনিয়ারিং ও অন্যান্য শিল্প। ব্রিটিশ উদ্যোগে ভারতে খুব সামান্য পরিমাণে হলেও ইঞ্জিনিয়ারিং, কাগজ, চামড়া, পশম, মদ, সিমেন্ট, দেশলাই, কাচ প্রভৃতি শিল্পের বিকাশ ঘটে।
ভারতীয় শিল্পোদ্যোগ
ভারতে ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের উদ্যোগে যতটা শিল্পের বিকাশ ঘটেছে, ভারতীয় উদ্যোগে ততটা নয়।
ভারতীয় উদ্যোগের প্রতিবন্ধকতার কারণ
এর কারণগুলি হল – ১) লাইসেন্স পেতে হয়রানি, ২) মূলধনের স্বল্পতা, ৩) রেল মাশুলের বৈষম্য, ৪) আমদানি-রপ্তানি শুল্কে বৈষম্য, ৫) যন্ত্রবিদের অভাব, ৬) সরকারি সহযোগিতা পেতে অসুবিধা ইত্যাদি।
বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতীয় উদ্যোগে বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ ও অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়।
Ø বস্ত্রশিল্প। রেলপথের সম্প্রসারণ, চিনের চাহিদা, স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাবে বস্ত্রশিল্পের অগ্রগতি তরান্বিত হয়। প্রধানত বোম্বাইকে কেন্দ্র করে এই শিল্পের প্রসার ঘটে। ১৮৫৩ সালে পারসি শিল্পপতি নানাভাই দাভর বোম্বাইতে সর্বপ্রথম কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর একে একে শোলাপুর, নাগপুর,সুরাট, কানপুর প্রভৃতি স্থানে কাপড়ের কল স্থাপিত হয়। ১৯০৫ সালে ভারতে কাপড়ের কলের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০৬।
Ø ইঞ্জিনিয়ারিং ও ভারী শিল্প। ইউরোপীয়দের অনীহা থাকলেও ভারতীয়রা এক্ষেত্রে কিছু মূলধন বিনিয়োগ করে। ১৮৬৭ সালে কিশোরীলাল মুখোপাধ্যায় শিবপুরে লোহার কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৮৯২ সালে রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ‘মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি’, নওয়াল কিশোর ‘লক্ষৌ আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৭ সালে জামশেদজি টাটা প্রতিষ্ঠা করেন ‘টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি’। ১৯০৬ সালে স্বদেশি আন্দোলনের সময় চিদাম্বরম পিল্লাই স্বদেশি জাহাজ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত এই ক্ষেত্রে ভারতীয়দের বিনিয়োগ ছিল শতকরা ৫ ভাগ।
Ø কয়লা শিল্প। ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে দ্বারকানাথ ঠাকুর ‘কার, টেগর অ্যান্ড কোম্পানি’ কয়লাখনির কাজে মূলধন বিনিয়োগ করেন। ১৮৯৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্ধমান জেলায় ৪০টি এবং ছোটনাগপুর ও মানভূম জেলায় ৬২টি কয়লাখনি ছিল ভারতীয় মালিকানায়। কয়লাখনির সন্ধানে জামশেদজি টাটা প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেন।
Ø চা শিল্প। ১৮৭৮ সালে জয়চাঁদ সান্যাল ‘জলপাইগুড়ি টি কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া মতিলাল শীল, দ্বারকানাথ ঠাকুর, মির্জা ইস্পাহানি প্রমুখ ভারতীয় চা শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ করেন।
Ø রাসায়নিক শিল্প। বিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ১৯০১ সালে কলকাতায় ঔষধ ও রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানা ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিকাল ওয়ার্কস’ প্রতিষ্ঠা করেন।
Ø অভ্র শিল্প। ১৮৯৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী হাজারিবাগ জেলার কোডার্মা অঞ্চলের ৩১১টি অভ্র খনির মধ্যে ৬৯টি ছিল ভারতীয় মালিকানায়। ৬৯টির মধ্যে ৪৬টির মালিক ছিলেন বাকুড়া-বিষ্ণুপুরের সাহানা পরিবার।
Ø অন্যান্য শিল্প।  এছাড়া স্বদেশি আন্দোলনের সময় দেশীয় উদ্যোগে তাঁতবস্ত্র, সাবান, চিনি, লবণ, ওষুধ, তেল, চিরুনি, দেশলাই, চামড়াজাত সামগ্রী তৈরির কারখানা গড়ে উঠতে থাকে।
উপসংহার
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ঊনিশ শতকের শেষ দিকে ভারতে শিল্পের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। ১৯০৫ সালে ভারতে কলকারখানার মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬৮৮টি। এই শিল্পায়নে ব্রিটিশ পুঁজির প্রাধান্য থাকলেও ভারতীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। তবে, ইউরোপীয় পুঁজি বিনিয়োগ ছিল কলকাতা কেন্দ্রীক, অন্যদিকে ভারতীয় বিনিয়োগ ছিল বোম্বাই কেন্দ্রীক।
Comment

Class XI Political Science

Class XII Political Science

Class 12 Bangla Books Question& Answers