দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের (১৯৪৫) পর পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ পরস্পর দুটি রাষ্ট্রজোটের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। একটি আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট অন্যটি সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট। এই দুই রাষ্ট্রজোট কোন প্রত্যক্ষ যুদ্ধ না করেও দীর্ঘকাল ধরে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও যুদ্ধের আবহ বা ছায়াযুদ্ধ চালাতে থাকে। এই ছায়াযুদ্ধই ইতিহাসে 'ঠান্ডা লড়াই' নাম পরিচিত।
মার্কিন সাংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান ( Walter Lippmaan ) ১৯৪৭ সালে তাঁর The Cold War গ্রন্থে সর্বপ্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন।
ঠান্ডা লড়াইয়ের বৈশিষ্ঠ্য :
ঠান্ডা লড়াইয়ের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নজরে আসে। এগুলি হল --
ঠান্ডা লড়াই ছিল ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোটের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
আমেরিকা ও রাশিয়া উভয়েই নিজের জোটের সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে আর্থিক, সামরিক ও অন্যান্য সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করেছিল।
ঠান্ডা লড়াইয়ের উভয় পক্ষই নিজ নিজ রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রচারে গুরুত্ব দিয়েছিল।
উভয় পক্ষই অস্ত্র তৈরিসহ সার্বিক সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে যথেষ্ট মনোযোগ দেয়।
আমেরিকা ও রাশিয়া উভয় পক্ষই সামরিক শক্তি যথেষ্ট বাড়ালেও কোন পক্ষই প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়ায় নি। কেবল যুদ্ধের আবহ জিইয়ে রেখেছিল।
তাত্ত্বিক ভিত্তি বা প্রকৃতি :
ঠান্ডা লড়াইয়ের তাত্ত্বিক ভিত্তি বা প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল --
১) আদর্শগত সংঘাতের ব্যাখ্যা ( ঐতিহ্য়বাহী বা রক্ষণশীল ব্যাখ্যা ) :
এই মতবাদে বিশ্বাসীদের মতে, ঠান্ডা যুদ্ধ ছিল আদর্শগত বিরোধ এবং এর জন্য দায়ী ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের উগ্র সম্প্রসারণ নীতি। এই নীতির জন্য পৃথিবীতে আতঙ্ক ও নিতাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়। তারা মিত্র শক্তির মত উপেক্ষা করে শক্তি প্রয়োগ করে পূর্ব-ইউরোপে কমিউনিস্ট সরকার গড়লে এই আতঙ্ক তৈরি হয়।
এই মতের পক্ষে যারা তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, উইনস্টোন চার্চিল, হার্বাট ফিস, জর্জ কেন্নান, জন স্পেনিয়ার প্রমুখ।
২) সংশোধনবাদী ব্যাখ্যা :
এই মতের সমর্থকরা মনে করেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারণশীল নীতি নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী নীতি ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা করেছিল।
ওয়াল্টার লিপম্যান তাঁর 'The Cold War' গ্রন্থে জর্জ এফ কেন্নার-এর সোভিয়েত ইউনিয়নের 'বেষ্টনী তত্ত্ব'কে অগ্রাহ্য করেন এবং বলেন, 'পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত সম্প্রসারণে বাধাদান করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঠান্ডা লড়াই ডেকে এনেছিল।'
ডি.এফ.ফ্লেমিং তাঁর 'The Cold War and its Origins ১৯১৭-১৯৬০' গ্রন্থে বলেছেন, 'মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান তাঁর পূর্বসূরী রুজভেল্ট অনুসৃত বিদেশনীতি থেকে সরে এসে রুশ বিরোধী নীতি গ্রহণ করেন এবং ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা করেন।'
গার অ্যালপারোভিজ দেখিয়েছেন, বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্বে আণবিক বোমা তৈরিতে সাফল্য পেয়ে আমেরিকা তার পূর্বেকার সহাবস্থানের নীতি থেকে সরে এসে ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতার নীতি গ্রহণ করলে ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভব ঘটে।' অবশ্য তিনি একই সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনমনীয়তারও উল্লেখ করেছেন।
৩) বাস্তববাদী ব্যাখ্যা :
একদল ঐতিহাসিক আদর্শগত এবং সংশোধনবাদী তত্ত্বের মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করে ঠান্ডা লড়াইযের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের মতে ঠান্ডা লড়াইয়ের জন্য দুপক্ষই দায়ী ছিল অথবা কোনো পক্ষই দায়ী ছিল না। তাঁদের এই ব্যাখ্যা বাস্তববাদী ব্যাখ্যা নামে পরিচিত।
এই মতের সমর্থক মরগ্যানথো দেখিয়েছেন, রুশ সম্প্রসারণ নীতি ও সাম্যবাদী আদর্শকে একই দৃষ্টিতে দেখে আমেরিকা অদূরদর্শিতার পরিচয় দেয়।
লুই জে. হ্যালে মনে করেন, ঠান্ডা লড়াই আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যেকার আদর্শগত সংঘাত ছিল না। তাঁর মতে, ক্ষমতার রাজনীতি ও শক্তিসাম্য থেকে এই লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটেছিল।
অধ্যাপক রিচার্ড ক্রকেট-এর মতে, আদর্শগত সংঘাত নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরী হয়েছিল তা দুই শক্তিধর দেশকে ঠান্ডা যুদ্ধের আঙিনায় আসার বাস্তব পটভূমি তৈরি করেছিল।
৪) অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাখ্যা :
এই মতবাদের ব্যাখ্যাকাররা মনে করেন, ঠান্ডা লড়াই ছিল প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের অন্যতম দিক।
গ্যাব্রিয়েল কলকো দেখিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। ফলে তারা বিশ্বে অর্থনীতির এক নম্বর চালকের আসন লাভের চেষ্টা করে। এই লক্ষেই মার্শাল প্লানের মাধ্যমে বিপুল অর্থ দিয়ে ইউরোপের পরিত্রাতা হিসাবে নিজেকে তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়। আর এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার অনুগত রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে আমেরিকা একপ্রকার ক্রুসেড ঘোষণা করে।
মূল্যায়ন : তবে একথা মনে রাখতে হবে যে, ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভবের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন কেউ এককভাবে দায়ী ছিল না। এর সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকের কাজ করেছিল।
মার্কিন সাংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান ( Walter Lippmaan ) ১৯৪৭ সালে তাঁর The Cold War গ্রন্থে সর্বপ্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন।
ঠান্ডা লড়াইয়ের বৈশিষ্ঠ্য :
ঠান্ডা লড়াইয়ের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নজরে আসে। এগুলি হল --
ঠান্ডা লড়াই ছিল ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোটের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
আমেরিকা ও রাশিয়া উভয়েই নিজের জোটের সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে আর্থিক, সামরিক ও অন্যান্য সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করেছিল।
ঠান্ডা লড়াইয়ের উভয় পক্ষই নিজ নিজ রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রচারে গুরুত্ব দিয়েছিল।
উভয় পক্ষই অস্ত্র তৈরিসহ সার্বিক সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে যথেষ্ট মনোযোগ দেয়।
আমেরিকা ও রাশিয়া উভয় পক্ষই সামরিক শক্তি যথেষ্ট বাড়ালেও কোন পক্ষই প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়ায় নি। কেবল যুদ্ধের আবহ জিইয়ে রেখেছিল।
তাত্ত্বিক ভিত্তি বা প্রকৃতি :
ঠান্ডা লড়াইয়ের তাত্ত্বিক ভিত্তি বা প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল --
১) আদর্শগত সংঘাতের ব্যাখ্যা ( ঐতিহ্য়বাহী বা রক্ষণশীল ব্যাখ্যা ) :
এই মতবাদে বিশ্বাসীদের মতে, ঠান্ডা যুদ্ধ ছিল আদর্শগত বিরোধ এবং এর জন্য দায়ী ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের উগ্র সম্প্রসারণ নীতি। এই নীতির জন্য পৃথিবীতে আতঙ্ক ও নিতাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়। তারা মিত্র শক্তির মত উপেক্ষা করে শক্তি প্রয়োগ করে পূর্ব-ইউরোপে কমিউনিস্ট সরকার গড়লে এই আতঙ্ক তৈরি হয়।
এই মতের পক্ষে যারা তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, উইনস্টোন চার্চিল, হার্বাট ফিস, জর্জ কেন্নান, জন স্পেনিয়ার প্রমুখ।
২) সংশোধনবাদী ব্যাখ্যা :
এই মতের সমর্থকরা মনে করেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারণশীল নীতি নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী নীতি ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা করেছিল।
ওয়াল্টার লিপম্যান তাঁর 'The Cold War' গ্রন্থে জর্জ এফ কেন্নার-এর সোভিয়েত ইউনিয়নের 'বেষ্টনী তত্ত্ব'কে অগ্রাহ্য করেন এবং বলেন, 'পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত সম্প্রসারণে বাধাদান করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঠান্ডা লড়াই ডেকে এনেছিল।'
ডি.এফ.ফ্লেমিং তাঁর 'The Cold War and its Origins ১৯১৭-১৯৬০' গ্রন্থে বলেছেন, 'মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান তাঁর পূর্বসূরী রুজভেল্ট অনুসৃত বিদেশনীতি থেকে সরে এসে রুশ বিরোধী নীতি গ্রহণ করেন এবং ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা করেন।'
গার অ্যালপারোভিজ দেখিয়েছেন, বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্বে আণবিক বোমা তৈরিতে সাফল্য পেয়ে আমেরিকা তার পূর্বেকার সহাবস্থানের নীতি থেকে সরে এসে ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতার নীতি গ্রহণ করলে ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভব ঘটে।' অবশ্য তিনি একই সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনমনীয়তারও উল্লেখ করেছেন।
৩) বাস্তববাদী ব্যাখ্যা :
একদল ঐতিহাসিক আদর্শগত এবং সংশোধনবাদী তত্ত্বের মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করে ঠান্ডা লড়াইযের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের মতে ঠান্ডা লড়াইয়ের জন্য দুপক্ষই দায়ী ছিল অথবা কোনো পক্ষই দায়ী ছিল না। তাঁদের এই ব্যাখ্যা বাস্তববাদী ব্যাখ্যা নামে পরিচিত।
এই মতের সমর্থক মরগ্যানথো দেখিয়েছেন, রুশ সম্প্রসারণ নীতি ও সাম্যবাদী আদর্শকে একই দৃষ্টিতে দেখে আমেরিকা অদূরদর্শিতার পরিচয় দেয়।
লুই জে. হ্যালে মনে করেন, ঠান্ডা লড়াই আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যেকার আদর্শগত সংঘাত ছিল না। তাঁর মতে, ক্ষমতার রাজনীতি ও শক্তিসাম্য থেকে এই লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটেছিল।
অধ্যাপক রিচার্ড ক্রকেট-এর মতে, আদর্শগত সংঘাত নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরী হয়েছিল তা দুই শক্তিধর দেশকে ঠান্ডা যুদ্ধের আঙিনায় আসার বাস্তব পটভূমি তৈরি করেছিল।
৪) অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাখ্যা :
এই মতবাদের ব্যাখ্যাকাররা মনে করেন, ঠান্ডা লড়াই ছিল প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের অন্যতম দিক।
গ্যাব্রিয়েল কলকো দেখিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। ফলে তারা বিশ্বে অর্থনীতির এক নম্বর চালকের আসন লাভের চেষ্টা করে। এই লক্ষেই মার্শাল প্লানের মাধ্যমে বিপুল অর্থ দিয়ে ইউরোপের পরিত্রাতা হিসাবে নিজেকে তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়। আর এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার অনুগত রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে আমেরিকা একপ্রকার ক্রুসেড ঘোষণা করে।
মূল্যায়ন : তবে একথা মনে রাখতে হবে যে, ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভবের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন কেউ এককভাবে দায়ী ছিল না। এর সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকের কাজ করেছিল।