অব-উপনিবেশীকরণ :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন উপনিবেশগুলি পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীনতা থেকে মুক্তি লাভের জন্য সংগ্রাম শুরু করে। সেই সূত্রে এই সময় অধিকাংশ উপনিবেশই স্বাধীনতা লাভ করে। ঔপনিবেশিক শক্তির নাগপাশ থেকে উপনিবেশগুলির মুক্তির ঘটনাকেই 'অব-উপনিবেশীকরণ' (Decolonisation) বলা হয়।
১৯৩২ সালে জার্মান পন্ডিত মরিৎস জুলিয়াস বন সর্বপ্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন।
Springhall তাঁর Encyclopedia of social science গ্রন্থে অব-উপনিবেশবাদ বলতে বুঝিয়েছেন ভূতপূর্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক উপনিবেশগুলির রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব সমর্পণ অথবা সার্বভৌম ক্ষমতা সাম্রাজ্যের হাত থেকে জাতি রাষ্ট্রগুলির হাতে সমর্পণ করা।
অর্থাৎ অব-উপনিবেশীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যেক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী শাসক তাদের ঔপনিবেশিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিকে প্রত্যাহার করে নেয়। আবার অন্য একটি ধারণা অনুযায়ী সক্রিয় মুক্তি সংগ্রাম এবং গণআন্দোলনের চাপে ঔপনিবেশিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি অনেকটাই সংকুচিত হয়।
উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের কারণ :
ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাতিন আমেরিকার উপনিবেশগুলোতে মুক্তিসংগ্রাম শুরু হওয়ার বিভিন্ন কারণ ছিল।
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব : ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে উপনিবেশগুলোতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে। ফলে সেখানকার মানুষ ইউরোপীয় নবজাগরণ থেকে উদ্ভুত জাতীয়তাবাদ ও মানবতাবাদী আদর্শের স্পর্শ পায়। তারা উপলব্ধি করে নিজ জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতা লাভের জন্য ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।
তীব্র অর্থনৈতিক শোষণ : ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি উপনিবেশগুলোতে তীব্র শোষণ চালিয়ে নিজ নিজ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটাতে থাকে। দিনের পর দিন উপনিবেশগুলোতে শোষণ চালানোর ফলে সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনে চরম দুর্গতি নেমে আসে। ফলে তারা বাধ্য হয়ে উপনিবেশগুলির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন : ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি উপনিবেশগুলিতে নিজেদের পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়। ফলে একদিকে যেমন নবজাগরণ ঘটে, অন্যদিকে তেমনি দেশীয় সংস্কৃতিও হুমকির মুখে পড়ে। তাই পশ্চিমি সভ্যতা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে নিজেদের সভ্যতা ও সংকৃতিকে বাঁচাতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি : পশ্চিমি ভাবধারার সংস্পর্শে আসার ফলে উপনিবেশের বাসিন্দাদের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কে চেতনা বাড়ে। ফলে তারা আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি জানাতে থাকে।
সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচার : সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠীর জাতিবিদ্বেষ ও অত্যাচার উপনিবেশের মানুষদের উপনিবেশ-বিরোধী করে তুলেছিল।
অব-উপনিবেশবাদের কারণ :
উপরোক্ত বিষয়গুলির কারণে উপনিবেশগুলিতে উপনিবেশ-বিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠে। এর সাথে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী যুক্ত হয়ে অব-উপনিবেশীকরণকে অনিবার্য করে তুলেছিল।
সাম্রাজ্যবাদীদের অন্তর্দন্দ্ব : নিজেদের মধ্যে প্রতিদন্দ্বিতার কারণে ইউরোপীয় শক্তিগুলি একে অপরের উপনিবেশে মুক্তি আন্দোলনকে উৎসাহিত ও সমর্থন করে। ফলে উপনিবেশিক ব্যবস্থা ধাক্কা খায়।
সাম্যবাদের প্রসার : সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান ও সাম্যবাদের অভূতপূর্ব প্রসার উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তার সক্রিয় সাহায্য ও সমর্থন উপনিবেশবাদের ওপর চরম আঘাত হেনেছিল।
মার্কিন প্রভাব : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মহাশক্তিধর হয়ে ওঠে। তারা ইউরোপের উপনিবেশগুলোতে স্বাধীনতা প্রদানের ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন ফ্রান্স প্রভৃতি ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। উপনিবেশগুলির জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য তারা জনগণকে স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওযার প্রতিশ্রুতি দেয়। যুদ্ধ শেষ হলে সেই প্রতিশ্রুতি আদায়ের আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে।
উদারনীতিবাদের প্রভাব : বেন্থাম, ডিসরেইলি, বার্ক প্রমুখ ব্রিটেন ও ফ্রান্সের উদারপন্থী চিন্তাবিদ ঔপনিবেশিক শাসনের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। ফলে ঔপনিবেশিক শাসকদের ওপর চাপ তৈরী হয়।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রভাব : ভারতের নেতৃত্বে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি নিজেরা উপনিবেশিক শাসনের শিকার ছিল বলে স্বধীনতার পর তারা উপনিবেশ-বিরোধী এই জোট গড়ে তোলে এবং অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে উৎসাহিত করেছিল।
জাতিপুঞ্জের ভূমিকা : ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র ও জাতির সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল জাতিপুঞ্জের অন্যতম লক্ষ্য। এব্যাপারে এই সংস্থা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করে যা উপনিবেশবাদ অবসানে সাহায্য করেছিল।
উপসংহার :
আসলে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সংস্পর্শে আসার ফলে এই সমস্ত উপনিবেশগুলিতে মানুষের মনে জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম নেয়। আর এই চেতনাই এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে মুক্তিসংগ্রামের জন্ম দেয়। এরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল অব-উপনিবেশিকরণ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন উপনিবেশগুলি পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীনতা থেকে মুক্তি লাভের জন্য সংগ্রাম শুরু করে। সেই সূত্রে এই সময় অধিকাংশ উপনিবেশই স্বাধীনতা লাভ করে। ঔপনিবেশিক শক্তির নাগপাশ থেকে উপনিবেশগুলির মুক্তির ঘটনাকেই 'অব-উপনিবেশীকরণ' (Decolonisation) বলা হয়।
১৯৩২ সালে জার্মান পন্ডিত মরিৎস জুলিয়াস বন সর্বপ্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন।
Springhall তাঁর Encyclopedia of social science গ্রন্থে অব-উপনিবেশবাদ বলতে বুঝিয়েছেন ভূতপূর্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক উপনিবেশগুলির রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব সমর্পণ অথবা সার্বভৌম ক্ষমতা সাম্রাজ্যের হাত থেকে জাতি রাষ্ট্রগুলির হাতে সমর্পণ করা।
অর্থাৎ অব-উপনিবেশীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যেক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী শাসক তাদের ঔপনিবেশিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিকে প্রত্যাহার করে নেয়। আবার অন্য একটি ধারণা অনুযায়ী সক্রিয় মুক্তি সংগ্রাম এবং গণআন্দোলনের চাপে ঔপনিবেশিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি অনেকটাই সংকুচিত হয়।
উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের কারণ :
ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাতিন আমেরিকার উপনিবেশগুলোতে মুক্তিসংগ্রাম শুরু হওয়ার বিভিন্ন কারণ ছিল।
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব : ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে উপনিবেশগুলোতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে। ফলে সেখানকার মানুষ ইউরোপীয় নবজাগরণ থেকে উদ্ভুত জাতীয়তাবাদ ও মানবতাবাদী আদর্শের স্পর্শ পায়। তারা উপলব্ধি করে নিজ জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতা লাভের জন্য ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।
তীব্র অর্থনৈতিক শোষণ : ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি উপনিবেশগুলোতে তীব্র শোষণ চালিয়ে নিজ নিজ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটাতে থাকে। দিনের পর দিন উপনিবেশগুলোতে শোষণ চালানোর ফলে সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনে চরম দুর্গতি নেমে আসে। ফলে তারা বাধ্য হয়ে উপনিবেশগুলির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন : ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি উপনিবেশগুলিতে নিজেদের পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়। ফলে একদিকে যেমন নবজাগরণ ঘটে, অন্যদিকে তেমনি দেশীয় সংস্কৃতিও হুমকির মুখে পড়ে। তাই পশ্চিমি সভ্যতা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে নিজেদের সভ্যতা ও সংকৃতিকে বাঁচাতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি : পশ্চিমি ভাবধারার সংস্পর্শে আসার ফলে উপনিবেশের বাসিন্দাদের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কে চেতনা বাড়ে। ফলে তারা আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি জানাতে থাকে।
সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচার : সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠীর জাতিবিদ্বেষ ও অত্যাচার উপনিবেশের মানুষদের উপনিবেশ-বিরোধী করে তুলেছিল।
অব-উপনিবেশবাদের কারণ :
উপরোক্ত বিষয়গুলির কারণে উপনিবেশগুলিতে উপনিবেশ-বিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠে। এর সাথে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী যুক্ত হয়ে অব-উপনিবেশীকরণকে অনিবার্য করে তুলেছিল।
সাম্রাজ্যবাদীদের অন্তর্দন্দ্ব : নিজেদের মধ্যে প্রতিদন্দ্বিতার কারণে ইউরোপীয় শক্তিগুলি একে অপরের উপনিবেশে মুক্তি আন্দোলনকে উৎসাহিত ও সমর্থন করে। ফলে উপনিবেশিক ব্যবস্থা ধাক্কা খায়।
সাম্যবাদের প্রসার : সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান ও সাম্যবাদের অভূতপূর্ব প্রসার উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তার সক্রিয় সাহায্য ও সমর্থন উপনিবেশবাদের ওপর চরম আঘাত হেনেছিল।
মার্কিন প্রভাব : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মহাশক্তিধর হয়ে ওঠে। তারা ইউরোপের উপনিবেশগুলোতে স্বাধীনতা প্রদানের ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন ফ্রান্স প্রভৃতি ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। উপনিবেশগুলির জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য তারা জনগণকে স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওযার প্রতিশ্রুতি দেয়। যুদ্ধ শেষ হলে সেই প্রতিশ্রুতি আদায়ের আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে।
উদারনীতিবাদের প্রভাব : বেন্থাম, ডিসরেইলি, বার্ক প্রমুখ ব্রিটেন ও ফ্রান্সের উদারপন্থী চিন্তাবিদ ঔপনিবেশিক শাসনের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। ফলে ঔপনিবেশিক শাসকদের ওপর চাপ তৈরী হয়।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রভাব : ভারতের নেতৃত্বে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি নিজেরা উপনিবেশিক শাসনের শিকার ছিল বলে স্বধীনতার পর তারা উপনিবেশ-বিরোধী এই জোট গড়ে তোলে এবং অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে উৎসাহিত করেছিল।
জাতিপুঞ্জের ভূমিকা : ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র ও জাতির সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল জাতিপুঞ্জের অন্যতম লক্ষ্য। এব্যাপারে এই সংস্থা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করে যা উপনিবেশবাদ অবসানে সাহায্য করেছিল।
উপসংহার :
আসলে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সংস্পর্শে আসার ফলে এই সমস্ত উপনিবেশগুলিতে মানুষের মনে জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম নেয়। আর এই চেতনাই এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে মুক্তিসংগ্রামের জন্ম দেয়। এরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল অব-উপনিবেশিকরণ।