Tuesday, 7 April 2020

সংজ্ঞা, প্রকৃতি, বিষয়বস্তু এবং সামাজিক সক্রিয়তা হিসাবে রাজনীতি বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর

সংজ্ঞা, প্রকৃতি, বিষয়বস্তু এবং সামাজিক সক্রিয়তা হিসাবে রাজনীতি
প্রশ্ন ১) রাষ্ট্রবিজ্ঞান কাকে বলে?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও ধারণা তার আলােচনা ক্ষেত্রের পরিধির দ্বারাই নির্ধারিত হয়। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানও হল গতিশীল বিজ্ঞান। মানুষের সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার পরিধিও পরিমার্জিত এবং পরিবর্তিত হয়েছে। তার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্বন্ধে ধারণারও বিবর্তন ঘটেছে। এই কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন সংজ্ঞার সৃষ্টি হয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দেওয়া সহজ নয়। কারণ, ওয়াসবি (Washby) বলেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে এত বেশি মতপার্থক্য আছে এবং এই বিষয়টি এতই পরিবর্তনশীল যে, এর একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়।
সাধারণ অর্থে বিজ্ঞান বলতে বােঝায়, বিশেষ জ্ঞান। সুতরাং যে শাস্ত্র পাঠ করলে রাষ্ট্র সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান পাওয়া যায়, তাকে বলা হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার মূল বিষয়বস্তু হল রাষ্ট্র। রাষ্ট্র সম্পর্কে আলােচনা বলতে বােঝায়—রাষ্ট্রের উৎপত্তি, গতি এবং প্রকৃতি বিষয়ে আলােচনা। সেদিক থেকে বলা যায়, যে শাস্ত্রের মূল বিষয়বস্তু হল রাষ্ট্র—তারই নাম রাষ্ট্রবিজ্ঞান।
অধ্যাপক গার্নারের (Garner) ভাষায়, “Political Science begins and ends with the State,” অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রকে নিয়ে আলােচনা শুরু এবং শেষ করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধু রাষ্ট্রকে নিয়ে আলােচনা করে না, সরকার নিয়েও আলােচনা করে। কারণ, রাষ্ট্রের ইচ্ছা সরকারের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। তাই গিলক্রাইস্ট (Gilchrist) বলেছেন, “Political Science deals with the State and Government.” অর্থাৎ যে শাস্ত্র রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে আলােচনা করে তাকে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অধ্যাপক গেটেল (Gettell) বলেছেন—বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাই এই প্রতিষ্ঠানের আলােচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেদিক থেকে বলা যায়, যে শাস্ত্র রাষ্ট্র, সরকার এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে আলােচনা করে, তাকে বলা হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান।
কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ এইসব সংজ্ঞা অসম্পূর্ণ বলে মনে করেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন, অ্যালান বল (Alan Ball), ডেভিড ইস্ট (David Eastan) প্রমুখ। এদের বক্তব্য হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধুমাত্র রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে আলােচনা করে না। সমাজের মধ্যে নানারকম বিরােধ ও সংঘাত আছে। তার মীমাংসার চেষ্টাকে বলে রাজনৈতিক কার্যকলাপ। আবার রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও ক্ষমতা এবং ব্যক্তিগত ও গােষ্ঠীগত রাজনৈতিক আচার-আচরণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। সুতরাং বলা যায়—যে শাস্ত্র রাষ্ট্র, সরকার, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক কার্যকলাপ, ক্ষমতা, ব্যক্তিগত ও গােষ্ঠীগত আচার-আচরণ প্রভৃতি আলােচনা করে, তাকে বলা হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান।
প্রশ্ন ২) রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের কোনাে প্রয়ােজনীয়তা আছে কি?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ করে সমাজ বিকাশের রাজনৈতিক ধারার অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তথা গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতিবন্ধকতা, দারিদ্র্য, বেকারি, শােষণ, ঔপনিবেশিকতা, পরাধীনতা প্রভৃতি বিষয়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সম্ভব হয়। বস্তুত রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের বহু প্রয়ােজনীয়তা আছে। কারণ—
প্রথমত, মানুষ রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ করে তার অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। এই অধিকার ও কর্তব্য সচেতনতা ছাড়া ব্যক্তিসত্তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাজনৈতিক জ্ঞানবিকাশের মধ্য দিয়ে নাগরিককে সরকারের ভিত্তি, প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করে।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তুলনামূলক আলােচনার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সরকারের গুণাগুণ উপলদ্ধি করা সম্ভব।
চতুর্থত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠে আগ্রহী হওয়ার ফলে মানুষের চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটে। এর ফলে মানুষ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানের পথ নির্দেশ করতে পারে।
পঞ্চমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সকলকে অভিন্নতার বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ করে। সমাজের সকলকে ভালােবাসতে শেখায়।
ষষ্ঠত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষা মানুষকে কুসংস্কারমুক্ত হতে সাহায্য করে।
সপ্তমত, মানুষের মধ্যে আন্তর্জাতিকতাবােধ, বিশ্ব-সৌভ্রাতৃত্ববােধ, সহনশীলতা, বিশ্বশান্তি প্রভৃতিকে জাগ্রত করতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
অষ্টমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিভিন্ন মতাদর্শ নিয়ে আলােচনা হয়। আলােচনা ও পর্যালােচনার মধ্য দিয়ে মানুষ শ্রেয়তর রাজনৈতিক মতাদর্শের সন্ধান পায়।
নবমত, বর্তমান যুগে ভূগােলের সীমারেখা দূর হয়ে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ঘটনাও আজ আমাদের জীবনে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।আজকের পৃথিবীতে কোনাে দেশ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারে না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার গতিপ্রকৃতি উপলব্ধি করাও বিশেষ প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। সেদিক থেকেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনা ও জ্ঞান বিশেষ সহায়ক।
প্রশ্ন ৩) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনার সীমাবদ্ধতাগুলি কী কী?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাষ্টবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনার তীব্র বিরােধিতা করেছেন। কারণ এরুপ আলােচনা সংকীর্ণতা-দোষে দুষ্ট। ম্যাকেঞ্জি (Mackenzie) এরুপ আলােচনার ধারাকে অত্যধিক, আইনমুখী, কৃত্রিম এবং খামখেয়ালিপূর্ণ বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ—
প্রথমত, বিশ্বের নতুন রাষ্ট্রগুলির প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এদের বেশিরভাগই দেশের ভেতর থেকে গড়ে ওঠেনি। তাদের ওপর হয় জোর করে রাষ্ট্রব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, নয়তাে বা বাছাই করা হয়েছে। তা ছাড়া, এইসব দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলির মধ্যেকার সম্পর্কও পশ্চিমি দেশগুলিতে বিদ্যমান সম্পর্কের অনুরূপ নয়। তাই কেবলমাত্র রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনার মাধ্যমে সব রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও কাঠামাে সম্পর্কে অভিন্ন ধারণা লাভ করা যায় না।
দ্বিতীয়ত, পশ্চিমি দেশগলিতে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সম্পর্কের পরিবর্তন সাধিত হওয়ার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পুরােনাে ধারণা পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সাবেকি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ধারণার সাহায্যে বর্তমানে রাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত, সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে ক্রমবর্ধমান সহযােগিতা রাষ্টবিজ্ঞানের আলােচনাক্ষেত্র সম্পর্কিত রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ধ্যানধারণার ওপর কঠিন আঘাত হেনেছে।
চতুর্থত, বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক গােষ্ঠীর আলােচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলােচনার সময় সামাজিক মনস্তত্ত্ব, ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজতত্ত্ব, সামাজিক ভাষাতত্ত্ব, সামাজিক নৃতত্ত্ব প্রভৃতির গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করতে শুরু করেছেন। ফলে গতানুগতিকতার বন্ধন ছিন্ন করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজের বৃহত্তর আলােচনায় অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে। তাই ডেভিড ইস্টন বলেছেন—যেসব উপাদান কোনাে ঘটনাকে রাজনৈতিক উৎকর্ষ প্রদান করে, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনা সেগুলিকে বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রশ্ন ৪) রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলার পেছনে কী কী যুক্তি আছে?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান না বলার পক্ষে যুক্তি দেখানাে হলেও অ্যারিস্টটল, পােলক প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলেছেন। পােলক বলেছেন— “যারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলতে অস্বীকার করেন, তাঁরা বিজ্ঞানের সংজ্ঞা জানেন না।” প্রকৃতপক্ষে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি বিজ্ঞান। কারণ—
প্রথমত, সাধারণ বিজ্ঞানের মতাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাধারণত সূত্র বের করা সম্ভব। যেমন, অ্যারিস্টটল বলেছেন যে, সমাজের মধ্যে বৈষম্য থাকলে বিক্ষোভ দেখা দিতে পারে। এই সূত্র কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত, সাধারণ বিজ্ঞানের মতাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর শ্রেণিবিভাগ, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ করা যায়। যেমন, অ্যারিস্টটল ১৫৮টি নগর-রাষ্ট্রের সংবিধান তুলনামূলক আলােচনা করে যে সূত্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তা অস্বীকার করা যাবে না। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে অনুরূপ অবস্থায় বিনা দ্বিধায় সেগুলি প্রয়ােগ করা যায়।
তৃতীয়ত, লর্ড ব্রাইস বলেছেন—মানষের রাজনৈতিক আচরণ জটিল হলেও তার মধ্যে বিশেষ 
সামঞ্জস্য দেখা যায়। এই সামঞ্জস্যপর্ণ আচরণ থেকে রাষ্টবিজ্ঞানের সাধারণ সূত্র বা নিয়ম নির্ধারণ করা যায়।
চতুর্থত, আধুনিককালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরীক্ষার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়ােগ করা সম্ভব হচ্ছে; পরিসংখ্যান ও গাণিতিক তত্ত্ব প্রয়ােগ করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আচরণবাদীরা এই তত্ত্ব প্রয়ােগের পক্ষপাতী। চার্লস মেরিয়াম, ল্যাসওয়েল প্রভৃতি আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলােচনার ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যান পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। প্রণব রায় এই পদ্ধতি প্রয়ােগ করে ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ধারা প্রবাহিত করেছেন।
প্রশ্ন ৫) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু সম্পর্কে মার্কসবাদীদের অভিমত কী?
উত্তর: মার্কসবাদীদের মতে, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে রাষ্ট্রের সহায়তায় অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রভুত্বকারী শ্রেণি নিজেদের শ্রেণি-শাসন ও শ্রেণি-শােষণকে অব্যাহত রাখার জন্য সচেষ্ট হয়, সেহেতু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাই হল, রাজনীতির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ আলােচ্য বিষয়। কারণ, এইরকম সমাজে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে শ্রেণিদ্বন্দ্ব বা শ্রেণিসংগ্রাম নিরন্তর চলতে থাকে। এই দ্বন্দ্বশীল সমাজে শ্রেণিগত স্বার্থরক্ষা ও উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য প্রতিটি শ্রেণি যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করে তার প্রতিফলন রাজনীতির মধ্যে ঘটে। তাই লেনিন বলেছেন—বিভিন্ন শ্রেণির সঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকারের সম্পর্ক এবং বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যেকার সম্পর্কই হল রাজনীতি। তবে, মার্কসবাদীদের মতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা রাজনীতির প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হলেও তা জাতিসমুহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং বিভিন্ন সামাজিক গােষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যেকার সম্পর্ককে নিয়েও আলােচনা করে। তা ছাড়া, বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত বলে মার্কসবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ মনে করেন। সুতরাং বলা যায়, রাষ্ট্রীয় কার্যে অংশগ্রহণ, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রীয় কার্যের বিভিন্ন রূপ, লক্ষ্য ও বিষয়বস্তু নির্ধারণকেই মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়সূচির অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে যেহেতু সমাজের বুক থেকে রাষ্ট্র অপ্রয়ােজনীয় বলে নিজেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে, সেহেতু এরূপ সমাজে রাজনীতির প্রকৃতি ও বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তন সূচিত হবে।
প্রশ্ন ৬) রাষ্ট্রবিজ্ঞান কোন কোন ক্ষেত্রে ইতিহাসের কাছে ঋণী?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইতিহাসের ওপর যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভরশীল। সে কারণেই তা ইতিহাসের কাছে ঋণী। রাষ্ট্রবিজ্ঞান কোন কোন ক্ষেত্রে ইতিহাসের কাছে ঋণী তা নিম্নে উল্লেখ করা হল—
প্রথমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃত উদ্দেশ্য হল আদর্শ সমাজ এবং আদর্শ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাকে ইতিহাসের দ্বারস্থ হতে হয়। কারণ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইতিহাস থেকে নানা তথ্য ও উপাদান সংগ্রহ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূত্র গড়ে তােলে। যেমন—ইতিহাস থেকে একনায়কের কার্যাবলি বিশ্লেষণ করে একনায়কতন্ত্রের দোষ-গুণ নির্ধারণ করা হয়। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইতিহাসের কাছে ঋণী।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র নিয়ে আলােচনা করে। কিন্তু রাষ্ট্র সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে গেলে রাষ্ট্র পূর্বে কেমন ছিল, কীভাবে বর্তমান অবস্থায় এসেছে, তা জানা প্রয়ােজন। এর জন্যে ইতিহাসের আশ্রয় নিতে হবে।
তৃতীয়ত, ইতিহাস প্রদত্ত তথ্যাদির ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি অতি সহজেই নির্ধারণ করতে সক্ষম হন। ফলে তুলনামূলক আলােচনার সাহায্যে আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে মতামত জ্ঞাপন করা তাঁদের পক্ষে সহজসাধ্য হয়। এইসব ঐতিহাসিক তথা যত বেশি পরিমাণে সংগৃহীত হবে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনাও তত বেশি গভীরতা লাভ করবে। উইলােবির মতে, “ইতিহাস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গভীরতা জোগান দেয়।”
চতুর্থত, ইতিহাসের ঘটনার পটভূমিতে অনেক সময় রাজনৈতিক মতবাদ গড়ে ওঠে। হবসের “লেভিয়াথান গ্রন্থ” ও “সামাজিক চুক্তি মতবাদ” ইংল্যান্ডে ঐতিহাসিক ঘটনার পটভূমিতে জন্ম নিয়েছিল।
পঞ্চমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেলিনেক বলেছেন—রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থাকে। তাদের কাজের মূল্যায়ন করতে গেলে অতীতে তারা কী ধরনের কাজ করত তা জানা দরকার। ইতিহাস এগুলি আমাদের জানতে সাহায্য করে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইতিহাসের কাছে ঋণী।
প্রশ্ন ৭) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে অর্থবিদ্যার কোন কোন ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে?
উত্তর: প্রাচীনকালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং অর্থনীতি পৃথক ছিল না। অ্যারিস্টট্‌ল অর্থবিদ্যাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অংশ হিসেবে মনে করতেন। তাই অর্থবিদ্যাকে পৃথক শাস্ত্র হিসেবে বর্ণনা না করে তাকে বলা হত Political Economy বা রাজনৈতিক অর্থনীতি। রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে গেলে তার অর্থনীতির বুনিয়াদকে শক্তিশালী করা প্রয়ােজন। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামাে দুর্বল হলে রাষ্ট্র দুর্বল হবে। কারণ, কল্যাণকর অর্থনীতির উপর রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি নির্ভর করে। উন্নয়নশীল দেশগুলির পক্ষে একথা সর্বাংশে সত্য। প্রকৃতপক্ষে, উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। কারণ—
প্রথমত, উভয় শাস্ত্রই সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনে সর্বাধিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠাকেই মৌল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে। মৌল লক্ষ্যের এই অভিন্নতার জন্য উভয় শাস্ত্র পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। মানুষের রাজনৈতিক জীবন ও অর্থনৈতিক জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে চিন্তা করা যায় না। রাষ্ট্র আইন তৈরি করে মানুষের কল্যাণের জন্য। অর্থনীতির উদ্দেশ্য হল, মানুষের অর্থনৈতিক মঙ্গল সাধন করা।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান যেমন অর্থবিদ্যাকে প্রভাবিত করে, ঠিক তেমনই অর্থবিদ্যাও রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে প্রভাবিত করে থাকে। দেশের অর্থনীতি রাজনীতির উপর নির্ভরশীল। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করা হবে কি না তা রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে। আবার দেশের রাজনীতি অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল। যেমন—অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিলে, রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক মতাদর্শের উপর অর্থনৈতিক কর্মসূচি গড়ে ওঠে। যেমন—যে দেশ উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সমর্থক, সে দেশ মিশ্র অর্থনীতি গ্রহণ করবে। যারা সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের সমর্থক, তারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গ্রহণ করবে। আবার অন্যদিকে অর্থনৈতিক তত্ত্ব, রাজনৈতিক কাঠামাে গড়ে তােলে। যেমন—মার্কসবাদীতত্ত্ব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে।
চতুর্থত, রাজনৈতিক গণতন্ত্রে আস্থাশীল অনেক দেশেই একটি প্রতিষ্ঠান একই সঙ্গে উভয় শাস্ত্রের পঠনপাঠন ও গবেষণার জন্য গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল লন্ডনের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠান এবং কানাডার অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠান।
প্রশ্ন ৮) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে মনােবিজ্ঞানের কোন কোন ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে?
উত্তর: আধুনিক কালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মনােবিজ্ঞান পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন টার্ডে, গ্রাহাম ওয়ালাস, বেজহট প্রভৃতি। এদের যুক্তি হল-
প্রথমত, সরকারের স্থায়িত্ব, শাসনব্যবস্থার সাফল্য প্রভৃতির ক্ষেত্রে জনগণের ধ্যানধারণা ও বিশ্বাস প্রভৃতি জানা দরকার। এর জন্য মনােবিজ্ঞানের আশ্রয় নিতে হবে। সেই কারণে বর্তমানে শুধু সরকার নয়, রাজনৈতিক দলগলি ক্ষমতালাভের উদ্দেশ্যে মনােবিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে রাজনৈতিক প্রচারকার্য চালান। তাই লর্ড ব্রাইস বলেছেন—’Political Science has its roots in Psychology.” অর্থাৎ মনােবিজ্ঞানের মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল নিহিত।
দ্বিতীয়ত, বর্তমানকালে ধর্মীয় বিশ্বাস, ভাবপ্রবণতা প্রভৃতি কারণে রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। রামমন্দির, বাবরি মসজিদ, খালিস্থান আন্দোলন প্রভৃতি এর উদাহরণ। এগুলির মােকাবিলা করতে গেলে মনােবিজ্ঞানের সাহায্য নেওয়া প্রয়ােজন।
তৃতীয়ত, গণতন্ত্রের প্রাণ হল জনমত। জনমত যত বলিষ্ঠ হবে, ততই গণতন্ত্র সফল হবে। রাজনৈতিক দলগুলিও জনমতকে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করে। একাজ করতে গেলে জনগণের মানসিক প্রবণতা জানা প্রয়ােজন।মনােবিজ্ঞানের মাধ্যমে এটি সম্ভব।
চতুর্থত, জাতীয়তাবােধ জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জাতির প্রতি ভালােবাসার নাম জাতীয়তাবােধ। এটি একটি ভাবগত ধারণা। এই চেতনার বা মানসিকতার সৃষ্টির জন্য মনােবিজ্ঞানের সাহায্য নেওয়া দরকার।
পঞ্চমত, শাসনব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করবে সরকারি আইন বা নীতি জনগণ কতটা মেনে নেবে তার উপর। যদি কোনাে আইন জনগণের মনে না ধরে, তাহলে তাদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পাবে। তাতে রাষ্ট্রের ভিত দুর্বল হবে। তাই শাসনব্যবস্থার সাফল্যের জন্য মনােবিজ্ঞানের সাহায্য নেওয়া প্রয়ােজন।
প্রশ্ন ৯) রাজনীতির সাবেকি ধারণা ও আধুনিক ধারণার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করাে।
উত্তর: রাজনীতির সাবেকি ধারণার সঙ্গে আধুনিক ধারণার নানা দিক থেকে পার্থক্য রয়েছে। যেমন—
প্রথমতসাবেকি ধারণায় রাজনীতি হল একটি মানবিক ক্রিয়া, কিন্তু তা কখনও সর্বজনীন নয়। কিন্তু আধুনিক ধারণায় রাজনীতি একটি সর্বজনীন মানবিক ক্রিয়া।
দ্বিতীয়ত, সাবেকি ধারণায় রাজনীতি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক অর্থাৎ এখানে রাজনীতি রাজনৈতিক। কিন্তু আধুনিক ধারণায় রাজনীতি সমাজকেন্দ্রিক বা সামাজিক। অর্থাৎ রাজনীতি অরাজনৈতিক।
তৃতীয়ত, সাবেকি ধারণায় রাষ্ট্রের প্রভাব, ক্ষমতা ও আধিপত্য এবং তাদের ঘিরে যাবতীয় রাজনৈতিক সংগঠন ও তাদের কাজকর্ম—এই হল রাজনীতির উপাদান। কিন্তু আধুনিক ধারণায়, সমাজের যে-কোনাে প্রানের বিরােধ ও তার নিস্পত্তি হল রাজনীতির উপাদান।
চতুর্থত, সাবেকি ধারণায় শুধু জনসম্পর্কিত বিষয়ই রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত। অপরদিকে, আধুনিক 
ধারণায় জনসম্পর্কিত বিষয় ছাড়াও ব্যক্তিগত ও একান্ত বিষয়ও রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত।
পঞ্চমত, সাবেকি ধারণায় রাজনীতি মূল্যবােধের দ্বারা লালিত। অপরদিকে, আধুনিক ধারণায় রাজনীতি মূল্যবােধ-নিরপেক্ষ।
যষ্ঠত, সাবেকি ধারণায় রাষ্ট্রীয় ক্রিয়া রপে রাজনীতির সক্রিয়তার এলাকা তুলনামূলকভাবে অনেক ছােটো। অপরদিকে, আধুনিক ধারণায় সামাজিক ক্রিয়া হিসেবে রাজনীতির সক্রিয়তার এলাকা তুলনামূলকভাবে অনেক বড়াে।
প্রশ্ন ১০) ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
উত্তর: ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে গভীর সম্পর্ক থাকলেও দুটি শাস্ত্রের মধ্যে বিভিন্ন দিকে পার্থক্য বর্তমান। যেমন—
প্রথমত, ইতিহাসের আলােচনার বিষয়বস্তু অনেক বেশি। কারণ—ইতিহাস রাজনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ধর্ম প্রভৃতি নিয়ে আলােচনা করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষের শুধু রাজনৈতিক দিক নিয়ে আলােচনা করে।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমন মতবাদ আছে—যা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। যেমন—ঐশ্বরিক মতবাদ, সামাজিক চুক্তি মতবাদ প্রভৃতি। তাই দুটি শাস্ত্র এক নয়।
তৃতীয়ত, ইতিহাস বর্ণনামূলক ; অর্থাৎ যা ঘটেছে, তা বর্ণনা করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান যা হওয়া উচিত, তাও আলােচনা করে। ইতিহাস উচিত-অনুচিত বিষয় নিয়ে আলােচনা করে না।
চতুর্থত, ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে ঘটনা পরিবেশন করে। অর্থাৎ সময়কাল ধরে সাজিয়ে পরপর ঘটনাগুলি বর্ণনা করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান ধারাবাহিকতা বজায় রাখে না। যেমন—গণতন্ত্র সম্পর্কে আলােচনা করতে গিয়ে একই সঙ্গে তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলােচনা করে।
পঞ্চমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধুমাত্র ইতিহাস থেকে উপাদান সংগ্রহ করে না। অন্যান্য শাস্ত্র থেকেও
উপাদান সংগ্রহ করে। যেমন—রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলােচনার ক্ষেত্রে অর্থনীতি, সমাজনীতি,
পরিসংখ্যান প্রভৃতি বিভিন্ন শাস্ত্রের সাহায্য নিয়ে থাকে।
প্রশ্ন ১১) মার্কসবাদের সঙ্গে উদারনীতিবাদের পার্থক্য কী?
উত্তর: প্রথমত, মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রনীতির বৈপ্লবিক তত্ত্বের কথা বলেন। কিন্তু উদারনীতিবাদীরা রাষ্ট্রনীতির দ্বন্দ্ব ও সহযােগিতার তত্ত্বে বিশ্বাসী।
দ্বিতীয়ত, বৈপ্লবিক তত্ত্ব শ্রেণিসংগ্রামের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং বৈপ্লবিক প্রকৃতির মধ্যেই রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণার মূল নিহিত আছে। মার্কসীয় তত্ত্বে বিপ্লব একই সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এই দুইয়ের মধ্যে কোনাে পার্থক্য নেই। কিন্তু উদারনৈতিক তত্ত্বে বিপ্লব কেবলমাত্র রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।
তৃতীয়ত, বিপ্লবের ফলে সরকার, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির পরিবর্তন ঘটে। বিপ্লব মানেই একটি নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থা ও সমাজ পদ্ধতি থেকে উন্নততর উৎপাদন ব্যবস্থা ও সমাজ পদ্ধতির রূপান্তর। প্রতিষ্ঠিত হবে শ্রেণিহীন সমাজ। শ্রেণিসংঘাত থাকবে না। রাষ্ট্রের আর প্রয়ােজন হবে না। প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজতন্ত্র। এই স্তরে বদলে যাবে রাষ্ট্রনীতির অর্থ। সামাজিক মানুষ হবে মুক্ত ও স্বাধীন। পক্ষান্তরে, উদারনীতিবাদীদের মতে, বিপ্লবের সঙ্গে অগাতর কোনাে সম্পর্ক নেই। আধুনিক উদারনীতিবাদীরা ‘প্রগতির’ এই ধারণাকেই অস্বীকার করেন।
এই দুই তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, মার্কসীয় তত্ত্বটিই একমাত্র তত্ত্ব যার সাহায্যে ইতিহাসের বিভিন্ন বিপ্লবের ঘটনাকে সাধারণ বৈজ্ঞানিক সূত্রের দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। এখানেই এই তত্ত্বের গুরুত্ব, তাৎপর্য, মুল্য যা উদারনীতিবাদীরা অস্বীকার করতে পারেন না।
প্রশ্ন ১২) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজবিদ্যার পার্থক্য লেখাে।
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিদ্যার মধ্যে সম্পর্ক গভীর হলেও উভয় শাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্য বর্তমান। নিম্নে সেগুলি আলােচিত হল-
প্রথমত, সমাজবিদ্যার আলােচনার বিষয়বস্তু অনেক বেশি। পরিবার, গােষ্ঠী প্রভৃতি সমাজের সব রকমের সংগঠন নিয়ে এই শাস্ত্র আলােচনা করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধুমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন নিয়ে আলােচনা করে।
দ্বিতীয়ত, সমাজবিদ্যার জন্ম অনেক আগে হয়েছে। মানুষ যখন সমাজ গঠন করতে শিখল, তখন সমাজবিদ্যার জন্ম। তার অনেক পরে যখন রাষ্ট্রের উৎপত্তি হল, তখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূত্রপাত হল।
ততীয়ত, সমাজবিদ্যা মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলােচনা করে। যেমন—পারিবারিক দিক, অর্থনৈতিক দিক প্রভৃতি। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধু তার রাজনৈতিক দিক নিয়ে আলােচনা করে।
চতুর্থত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বাস্তব অবস্থা ছাড়া আদর্শ রাষ্ট্রের প্রকৃতি নিয়ে আলােচনা করে। যেমন— রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্লেটো তাঁর বিশিষ্ট গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সমাজবিদ্যা শুধুমাত্র বাস্তব সমাজের অবস্থা নিয়ে আলােচনা করে।
প্রশ্ন ১৩) রাষ্ট্রনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলতে কী বােঝ?
উত্তর: গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (Aristotle) রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে রাষ্ট্রনীতি নামে অভিহিত করেন। অ্যারিস্টটলের গ্রন্থটির নাম হল ‘পলিটিকস’ (Politics)। এছাড়া সিজউইক (Sidgwick), অ্যাক্টন (Acton), লিপসন (Lipson) প্রমুখরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিবর্তে রাষ্ট্রনীতি শব্দটিকে ব্যবহার করেন।
গ্রিক শব্দ পলিশ (Polis) থেকে Politics শব্দটি উদ্ভূত। পলিশ-এর অর্থ হল নগর। সুতরাং নগররাষ্ট্র ও তার সমস্যার আলােচনা হল রাষ্ট্রনীতি বা Politics। কিন্তু আধুনিক যুগে রাষ্ট্রীয় জীবন জটিল হওয়ার দরুন রাষ্ট্রনীতির পরিবর্তে অনেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান শব্দটি প্রয়ােগ করার পক্ষপাতী। সামগ্রিকভাবে মানুষের রাজনৈতিক জীবনের সুবিন্যস্ত আলােচনাই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অধ্যাপক গিলক্রাইস্ট (Gilchrist) বর্তমানে ভিন্ন অর্থে রাষ্ট্রনীতি শব্দটি প্রয়ােগ করেন। তাঁর মতে সরকারি নীতি নির্ধারণ ও প্রয়ােগকে রাষ্ট্রনীতি বলা হয়। পােলক রাষ্ট্রনীতিকে দু-ভাগে বিভক্ত করেন—তত্ত্বগত রাষ্ট্রনীতি ও ব্যাবহারিক রাষ্ট্রনীতি। তত্ত্বগত রাষ্ট্রনীতি শুধুমাত্র রাষ্ট্র, সরকার, আইন ইত্যাদি সম্পর্কে তাত্ত্বিক আলােচনা করে। কিন্তু ব্যাবহারিক রাষ্ট্রনীতি রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে আলােচনা করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রনীতির তুলনায় অধিকতর ব্যাপক। অধ্যাপক গার্নারের (Garner) মতে রাষ্ট্রের ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত জ্ঞান হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অন্যদিকে, বাস্তব প্রশাসনের সঙ্গে সংযুক্ত কার্যাবলি হল রাষ্ট্রনীতি।
প্রশ্ন ১৪) রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং নীতিশাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্য লেখাে।
উত্তর: গ্রিক দার্শনিকগণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে নীতিশাস্ত্রের অন্যতম শাখা হিসেবে গণ্য করতেন। তাঁদের মতে জনগণের জন্য মঙ্গলময় সুন্দর জীবন সম্ভব করে তােলাই হল রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জির (W.J.M. Mackenie) মতে, আচার-আচরণের ভালােমন্দের আলােচনাই হল নীতিশাস্ত্র। ইটালির দার্শনিক মেকিয়াভেলি (Machiavelli) রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে পৃথক শাস্ত্রের মর্যাদা দেন।
আধুনিক কালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রের মধ্যে বহুক্ষেত্রে পার্থক্য লক্ষ করা যায়। যেমন—
প্রথমত, নীতিশাস্ত্র মানুষের চিন্তা ও বাহ্যিক আচার-আচরণ উভয়কে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান। কেবল মানুষের বাহ্যিক কার্যকলাপ নিয়ে আলােচনা করে।
দ্বিতীয়ত, নীতিশাস্ত্রের নির্দেশ হল ন্যায়ভিত্তিক। ন্যায়-অন্যায় বােধ থেকে নীতিশাস্ত্রের প্রতিপাদ্য সূত্রগুলির সৃষ্টি হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে যা বেআইনি কাজ তা নীতিবিরুদ্ধ নাও হতে পারে।
তৃতীয়ত, ন্যায়নীতি বােধ সকল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রায় একই রকম কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন দেশভেদে
ভিন্ন রকম হতে পারে।
চতুর্থত, রাষ্ট্রীয় আইন বাধ্যতামূলক। কিন্তু নৈতিক বিধান বাধ্যতামূলক নয়।
পঞ্চমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান নবীন শাস্ত্র। কিন্তু নীতিশাস্ত্র রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তুলনায় প্রাচীন শাস্ত্র।
Comment

Class XI Political Science

Class XII Political Science

Class 12 Bangla Books Question& Answers