স্মৃতি বলতে মনে রাখা বিষয়কে বোঝায়, যার মধ্য দিয়ে নিকট অতীতকে স্মরণ করা যায়। কোনো কোনো ব্যক্তি তাঁর জীবনের ফেলে আসা সময়ের কোনো ঘটনার স্মৃতিচারণ বা প্রকাশ করে অতীতকে স্মরণ করে। এই অতীত স্মরণকেই বলা হয় স্মৃতিকথা।
অন্যভাবে বলা যায়, স্মৃতিকথা হল এক ধরণের সাহিত্য, যেখানে লেখক তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া বা প্রত্যক্ষ করা বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ স্মৃতি থেকে তুলে ধরেন।
উদাহরণ – জ্যোতি বসুর লেখা “যতদূর মনে পড়ে”। ইংরেজ শাসন ও স্বাধীন ভারতের ইতিহাস জানতে সাহায্য করে।
স্মৃতিকথার বৈশিষ্ট্য
স্মৃতিকথার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
1) স্মৃতিকথা হল ইতিহাসের একটি অন্যতম মৌখিক উপাদান। স্থানীয় ইতিহাস লেখায় এটি বিশেষ উপযোগী।
2) স্মৃতিকথা কোন কাল্পনিক কাহিনি নয়। এর একটি বাস্তব ভিত্তি আছে।
3) স্মৃতিকথায় লেখকের সারা জীবনের অভিজ্ঞতার আলোচনা থাকে না। থাকে জীবনকালে ঘটে যাওয়া সুনির্দিষ্ট কিছু ঘটনার বিবরণ। যেমন, হিরন্ময় বন্দোপাধ্যায়ের “উদবাস্তু”। এখানে কেবল পশ্চিমবঙ্গের উদবাস্তুদের জীবন সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে।
4) লেখক এখানে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ঘটনার বিশ্লেষণ করে থাকেন।
5) লেখক নিজে কাহিনির কথক হিসাবে কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যান। তাই রচনার উপস্থাপনা হয় উত্তম পুরুষে।
6) স্মৃতিকথায় লেখকের কোন ঘটনা সম্পর্কে নিজস্ব অনুভূতি প্রকাশিত হয়। যেমন, দক্ষিণারঞ্জন বসুর “ছেড়ে আসা গ্রাম” গ্রন্থে দেশভাগের যন্ত্রণার বিশেষ অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে।
স্মৃতিকথার উদাহরণ –
লেখক
|
স্মৃতিকথা
|
বিষয়বস্তু
| |
১.
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
|
জীবনস্মৃতি
|
ঠাকুরবাড়ির পরিবেশ, স্বদেশ ভাবনা
|
২.
|
মান্না দে
|
জীবনের জলসাঘরে
|
মুম্বাই ও কলকাতার সংগীত জীবন
|
৩.
|
সুফিয়া কামাল
|
একাত্তরের ডাইরি
|
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনির বর্বরতা
|
৪.
|
নারায়ণ সান্যাল
|
আমি নেতাজিকে দেখেছি
|
সুভাষ বসুর রাজনৈতিক জীবন
|
৫.
|
আশালতা সরকার
|
আমি সূর্য সেনের শিষ্যা
|
বিপ্লবী আন্দোলন ও সূর্য সেন
|
৬.
|
মনিকুন্তলা সেন
|
সেদিনের কথা
|
১৯৪৬ সালের কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
|
৭.
|
স্ট্রাগল ইন মাই লাইফ
|
নেলসন ম্যান্ডেলা
|
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী সংগ্রাম
|
৮.
|
সেমন্তী ঘোষ
|
দেশভাগ – স্মৃতি ও স্তব্ধতা
|
দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
|
৯.
|
সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
|
দেশভাগ – স্মৃতি আর স্বত্তা
|
দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
|
১০.
|
মহাত্মা গান্ধি
|
দি স্টোরি অব মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ
|
সত্যাগ্রহ আদর্শ ও অহিংস আন্দোলনের স্মৃতি
|
১১.
|
মৌলানা আবুল কালাম আজাদ
|
ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডম
|
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয় কংগ্রেসের ভূমিকা
|
১২.
|
বুদ্ধদেব বসু
|
আমার জীবন
|
পূর্ববাংলার গ্রাম্যজীবন
|
১৩.
|
সমর সেন
|
বাবুবৃত্তান্ত
|
তাঁর ফেলে আসা জীবনের কথা
|
১৪.
|
বীণা দাস
|
শৃঙ্খল ঝংকার
|
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘটনা
|
স্মৃতিকথার গুরুত্ব
ভারতের ইতিহাস রচনায় স্মৃতিকথার গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য –
1) গুণিজনদের লেখা তথ্য। স্মৃতিকথাগুলি অধিকাংশই গুণীজনদের লেখা। তাই তাতে অবান্তর,পক্ষপাতমূলক ও অতিরঞ্জিত ঘটনার প্রবেশের সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম থাক্বে।
2) বাস্তবতা। স্মৃতিকথাগুলি কাল্পনিক বিষয় নয়। তাই এগুলি থেকে অতীতের বিভিন্ন বাস্তব তথ্য ও বিবরণ পাওয়া যায়।
3) প্রত্যক্ষ সাক্ষী। বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে ঘটনার বিবরণ দেন। তাই উক্ত বিবরণে তথ্যের সত্যতা অনেক বেশি থাকে।
4) স্থানীয় ইতিহাসের উপাদান। স্মৃতিকথা হল ইতিহাসের একটি অন্যতম মৌখিক উপাদান। স্থানীয় ইতিহাস লেখায় এটি বিশেষ উপযোগী।
সমালোচনা বা মূল্যায়ন
তবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সঠিক উপাদান স্মৃতিকথা থেকে পাওয়া যায় না। কেননা –
1. কোনো বিশেষ মতাদর্শের প্রতি সমর্থন জানাতে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা অতিরঞ্জিত হয়ে যায়।
2. স্বল্পশিক্ষিত ব্যক্তি অনেক সময় সঠিক তথ্য তুলে ধরতে পারেন না।
3. একই ঘটনা বহুকাল পরে বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিকথায় বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়। ফলে সঠিক ঘটনা জানা কখনো কখনো মুশকিল হয়ে পড়ে।
সুতরাং বলা যায়,
v যেখানে লিখিত ইতিহাস পৌছাতে পারে না, সেখানেই স্মৃতিকথার প্রয়োজন হয়।
v স্মৃতিকথা গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে।