Thursday 26 March 2020

ডিরোজিও কে ছিলেন? ইয়ংবেঙ্গল কী? ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলন বলতে কী বোঝ? এই আন্দোলনের মূল্যায়ন কর।

ডিরোজিও ও ইয়ংবেঙ্গল :
ঔপনিবেশিক শাসনকালে বাংলার সামাজিক ও সংস্কৃতিক আন্দোলনে যারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। তিনি ছিলেন হিন্দু কলেজের শিক্ষক। ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের ( তাঁর অনুগামীদের ) নিয়ে তিনি যে সংগঠন গড়ে তোলেন বাংলার ইতিহাসে তা ( তাঁর অনুগামীরা ) 'ইয়ংবেঙ্গল' বা 'নব্যবঙ্গ' নামে পরিচিত।
নব্যবঙ্গ আন্দোলন :
পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে এসে এবং মিল, বেন্থাম, টম পেইন, রুশো, ভলতেয়ার প্রমুখ দার্শনিকদের রচনা পাঠের ফলে ডিরোজিওর অনুগামীদের মনে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনষ্কতা, মানবতাবাদ, জাতীয়তাবাদ  ইত্যাদি চেতনার জন্ম হয়। ডিরোজিওর নেতৃত্বে এই তরুণরা প্রচলিত হিন্দু ধর্ম ও সামাজিক কুসংস্কারগুলির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু করেন তা 'নব্যবঙ্গ আন্দোলন' নামে পরিচিত।
আন্দোলনের লক্ষ্য (উদ্দেশ্য ) :
জাতীয়তাবাদের মন্ত্রগুরু রাজা রামমোহন রায় ভারতে যে যুক্তিবাদের বীজ বপন করেন ডিরোজিও সেটিকে মহিরুহে পরিণত করার চেষ্টা করেন। তাঁর এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য (লক্ষ্য) ছিল --
অন্ধবিশ্বাস ত্যাগ করে ছাত্রদের যুক্তিবাদী ও সত্যসন্ধানী করে তোলা।
ছাত্রদের মধ্যে বিজ্ঞানমনষ্কতা ও মানবতাবাদের প্রসার ঘটানো।
প্রচলিত সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার বা কুসংস্কারগুলির বিরুদ্ধে স্বাধীন মতামত প্রদানের ব্যবস্থা করে ছাত্রদের মনে স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটানো।
নারী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলা।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা।
স্বদেশপ্রেম বা জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটানো ইত্যাদি।
আর এক্ষেত্রে তিনি অনেকটাই সফল হয়েছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর 'রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ' গ্রন্থে শিক্ষক ডিরোজিও সম্পর্কে বলেছেন, "চুম্বক যেমন লৌহকে আকর্ষণ করে, তেমনি তিনিও বালকদিগকে আকর্ষণ করিতেন।" প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন ছাত্রদের বন্ধু ও পথপ্রদর্শক।
ডিরোজিওর নেতৃত্বে আন্দোলন :
ইয়ংবেঙ্গল দলের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য ডিরোজিও বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা :
প্রচলিত সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার বা কুসংস্কারগুলির বিরুদ্ধে স্বাধীন মতামত প্রদানের ব্যবস্থা করে ছাত্রদের মনে স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে ১৮২৮ সালে মানিকতলায় এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
বিভিন্ন পত্রিকা প্রকাশ :
১) ডিরোজিওর 'অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন'-এর মুখপাত্র ছিল এথেনিয়াম।
২) ১৮৩০ সালে প্রকাশিত হয় পার্থেনন পত্রিকা। এতে নারী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।
৩) ডিরোজিও 'ক্যালাইডোস্কোপ' পত্রিকার মাধ্যমে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হন।
৪) এছাড়া 'হেসপেরাস' ও 'ক্যালকাটা লিটারেরি গেজেট' নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এই সমস্ত পত্রিকার মাধ্যমে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা ও স্বদেশপ্রেম বা জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটানোর উদ্যোগ নেন। ভারতের প্রতি গভীর দেশপ্রেমের প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর 'ফকির অব জঙ্গিরা' এবং 'ভারতবর্ষ, আমার স্বদেশের প্রতি' কবিতায়।
ডিরোজিও পরবর্তী আন্দোলন :
ডিরোজিওর মৃত্যুর পর তাঁর অনুগামীরা আন্দোলনের হাল ধরেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, তারাচাঁদ চক্রবর্তী প্রমুখ।
সংগঠন প্রতিষ্ঠা :
এঁরা যে সমস্ত সংগঠন গড়ে তোলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সাধারণ জ্ঞানোপার্জনী সভা (১৮৩৬)। রাজনৈতিক কার্যকলাপ প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁরা ১৮৪৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন 'বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি'।
পত্রিকা প্রকাশ :
অনুগামীদের দ্বারা প্রকাশিত কয়েকটি পত্রিকাও ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'জ্ঞানান্বেষণ', 'এনকোয়্যারার', বেঙ্গল স্পেকটেটর', হিন্দু পাইওনিয়ার'।
আন্দোলনের কার্যকলাপ ( কর্মসূচি ) :
ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলনকারীরা যে সমস্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন সেগুলি হল :  খ্রিষ্টান পাদরিদের গোড়ামি, স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য, দাস প্রথা, নারীনির্যাতন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ভারতের পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থা, কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, এবং সর্বপরি সামাজিক ও ধর্মীয় কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা।
আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা ( ব্যর্থতা ) :
কিছু অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতার কারণে এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। এই কারণগুলি হল :
ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলনের কোন গঠনমূলক কর্মসূচি ছিল না। তাঁদের কিছু চিন্তাধারা ও কর্মসূচি ছিল নেতিবাচক। ফলে তাঁরা তেমন জনসমর্থন পাননি।
তাঁদের আন্দোলন শহরকেন্দ্রিক কিছু অভিজাত পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ মানুষের সঙ্গে এঁদের কোনো যোগসূত্র গড়ে ওঠে নি।
দেশের দুর্দশাগ্রস্থ কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের সমস্যাবলি তাঁদের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হয় নি।
এই আন্দোলনের সদস্যরা সীমাহীন প্রগতিশীলতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এ ধরণের প্রগতিশীলতা সাদরে গ্রহণ করার মত সহনশীলতা তখনও সমাজে তৈরি হয় নি।
তৎকালীন সমাজের একটি বড় অংশ ছিল মুসলিম। তাদের এই আন্দোলনের স্পর্শ করে নি।
সর্বপরি ডিরোজিওর মৃত্যুর পর এই আন্দোলনের অনেক কর্মী চিরাচরিত ঐতিহ্যে ফিরে যায়।
গুরত্ব বা তাৎপর্য :
এই সমস্ত কারণে ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলন খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। পরবর্তী নেতৃত্বের মধ্যেও মতপার্থক্য দেখা দেয়। ডেভিড কফ তাঁদের 'ভ্রান্ত পুথিপড়া বুদ্ধিজীবী' বলে সমালোচনা করেন। ড. সুমিত সরকারও এদের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে একথা ভুললে চলবে না যে তাঁদের কার্যাবলীকে আপাতদৃষ্টিতে নৈরাজ্যবাদী বলে মনে হলেও বাংলার সমাজ জীবনে তার গভীর প্রভাব পড়েছিল। বাঙালির মধ্যে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা, ও কুসংস্কার মুক্ত মানসিকতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।
Comment

Class XI Political Science

Class XII Political Science

Class 12 Bangla Books Question& Answers