Thursday, 26 March 2020

আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আলোচনা করো। এই আন্দোলনে বেন বেল্লার কৃতিত্ব নিরূপণ করো।

আহমেদ বেন বেল্লা :
আলজেরিয়া হল আফ্রিকা মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। আরবের মুসলিমরা সপ্তম শতকের শেষদিকে এখানে এসে ইসলাম ধর্ম ও আরবি ভাষার প্রসার ঘটায়। ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ফরাসিরা এখানে আসে এবং তাদের ঔপনিবেশিক আধিপত্য কায়েম করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ফরাসি শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। যার নেতৃত্বে এই আন্দোলন ব্যাপকতা পায় তিনি হলেন আলজেরিয়ার জাতীয়তাবাদী নেতা আহমেদ বেন বেল্লা। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৬২ সালে আলজেরিয়া স্বাধীনতা লাভ করে।
মুক্তি-সংগ্রামের প্রেক্ষাপট ( কারণ ) :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে অধিকাংশ ফরাসি উপনিবেশে মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়। এই সময় আলজেরিয়ার জাতীয়তাবাদীরাও ফরাসি অধীনতা মুক্ত হয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রাপ্তির লক্ষ্যে  ঝাঁপিয়ে পড়ে। যে যে বিষয়গুলি তাঁদের এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বা কারণ হিসাবে কাজ করেছিল সেগুলি হল ---
ভুল উপনিবেশিক নীতি : ফরাসিরা দাবি করত যে, আলজেরিয়া মোটেই ফ্রান্সের উপনিবেশ নয়, এটি ফ্রান্সের নিজস্ব অংশ। ফলে এটিকে ফরাসি দেশের অংশে পরিণত করতে তারা কঠোর নীতি নিতে শুরু করে।
ভাষা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন : এই উদ্দেশ্যে তারা সেখানকার বাসিন্দাদের ফরাসি নাগরিকে পরিণত করার চেষ্টা চালায়। এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
অর্থনৈতিক আধিপত্য : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে আলজেরিয়ায় শ্বেতাঙ্গ ফরাসি বাসিন্দাদের সংখ্যা ১০ লক্ষ্যে পৌঁছায়। কৃষি জমির ১/৩ অংশ ও রপ্তানি বাণিজ্যের অধিকাংশই তাদের দখলে চলে যায়। এদের শোষণ ও নির্যাতনে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
নাগরিক অধিকারে বঞ্চনা : এই শ্বেতাঙ্গ ফরাসিরাই সমস্ত রকম নাগরিক অধিকার ও সুবিধা ভোগ করলেও সেখানকার স্থানীয় সাধারণ নাগরিকরা এই অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যায়।
ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ : এই শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী ও সাধারণ মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। ১৯৪৫ সালে এই ধরণের  একটি প্রতিবাদী মিছিলে ফরাসি সরকার তীব্র দমননীতি প্রয়োগ করলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আগুনের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে।
ফরাসি বাসিন্দাদের বিরোধিতা : ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনকে সেখানকার শ্বেতাঙ্গ ফরাসি বাসিন্দারা সমর্থন করেনি। তারা ফরাসি শাসনকে সমর্থন করে তাকে বজায় রাখার দাবি জানায়। ফলে শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে আলজেরিয়দের ক্ষোভ জন্মায়।
ইন্দোচীনে ফরাসি ব্যর্থতা : ১৯৫৪ সালে 'দিয়েন বিয়েন ফু র যুদ্ধে ফ্রান্স শোচনীয় ভাবে পরাজিত হলে ইন্দোচিনে ফরাসি আধিপত্য লুপ্ত হয়। এই ঘটনায় আলজেরিয়রা উপলব্ধি করে, তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে ফরাসিদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করা সম্ভব।
কঠোর দমননীতি : ইন্দোচিনের ঘটনায় আলজেরিয়রা উৎসাহিত হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনকে তীব্র আকার দেয়। ফরাসিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশ হওয়ায় তারাও এটিকে হাতছাড়া করতে রাজি ছিল না। হলে ফরাসি সরকার দমননীতিকে আরও কঠোর করে তোলে। 
ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (NLF) গঠন : এই পরিস্থিতিতে ১৯৫৪ সালে ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট নামে একটি জঙ্গি জাতীয়তাবাদী দল গড়ে তোলেন আহমেদ বেন বেল্লা। তাঁর আন্দোলনের চাপে শেষপর্যন্ত ১৯৬২ সালে আলজেরিয়া স্বাধীনতা লাভ করে।
জাতি গঠন ও বিকাশের বিভিন্ন পর্যায় :
আধুনিক আলজেরিয়ার বিকাশ ও জাতি গঠনের ধারাকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়।
প্রথম পর্যায় ( ১৯০০ - ১৯৫৪ ) : এই পর্বে আলজেরিয়া ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরাসি উপনিবেশ। এই সময় আলজেরিয়ার সাধারণ মানুষের ওপর ফরাসিরা ব্যাপক ঔপনিবেশিক শোষণ চালায়। সেই সঙ্গে এখানে আধুনিক শিক্ষার প্রসারেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ফলে আলজেরিয়দের মধ্যে এই সময় জাতি-চেতনা গড়ে উঠতে থাকে। তারা উপলব্ধি করে প্রতিবাদের পথে অগ্রসর না হলে ফরাসিরা চিরকাল তাদের ওপর শোষণ চালিয়ে যাবে। এই ভাবনা থেকেই তাঁরা ফরাসি ঔপনিবেশিক শোষণের  বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হতে থাকে। অবশেষে ১৯৫৪ সালে তাঁরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
দ্বিতীয় পর্যায় ( ১৯৫৪ - ১৯৬২ ) : জাতি গঠনের এই পর্যায়ে আলজেরিয়ায় ফরাসি শক্তির বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট এর প্রধান নেতা আহমেদ বেন বেল্লা। জাতীয় সংহতি ও জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ আলজেরিয়ার জনগণ বিদেশি শাসকদের বিতাড়িত করে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে জীবনমরণ সংগ্রামে শামিল হয়। শেষ পর্যন্ত ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তির পতন ঘটে। ১৯৬২ সালে ঐক্যবদ্ধ, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতান্ত্রিক আলজেরিয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে। আহমেদ বেন বেল্লা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এই সময় আলজেরিয়ার জাতীয়তাবাদী চেতনার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে।
তৃতীয় পর্যায় ( ১৯৬২ - ১৯৯০ ) : তৃতীয় আলজেরিয়া একটি সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রায় ৮ লক্ষ ফরাসি এই সময় আলজেরিয়া ছেড়ে দেশে ফিরে যায়। এদিকে রাষ্ট্রপতি পদে বসার ৩ বছরের মধ্যেই বেন বেল্লা ক্ষমতাচ্যুত হন। তাঁর মন্ত্রী হৌয়ারি বৌমডিয়েন ক্ষমতা দখল করেন। তবে বেন বেল্লার উদ্যোগে যেসব সমাজতান্ত্রিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তা তিনি ভাল রাখেন। তাঁর আমলে কৃষি ও শিল্পায়নে যথেষ্ট গতি আসে। তবে সামরিক শক্তির সহায়তায় শাসন পরিচালনা করায় আস্তে আস্তে তার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। এই সময় দেশে ইসলামী মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ১৯৯০ এর দশকে সামরিক বাহিনি ও ইসলামী মৌলবাদীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্য বাধে।
মূল্যায়ন :
স্বাধীনতা লেভার সময় আলজেরিয়ার অর্থনীতি ছিল খুবই অনুন্নত। কিন্তু স্বাধীনতার পর আহমেদ বেন বেল্লার নেতৃত্বে সরকার আধুনিকীকরণের উদ্যোগ নেয়। হৌয়ারি বৌমডিয়েনও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ফলে কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ঘটে। সেই সূত্রেই আলজেরিয়া বর্তমান আফ্রিকার একটি অন্যতম ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। 
Comment

Class XI Political Science

Class XII Political Science

Class 12 Bangla Books Question& Answers