উঃ
লিঙ্গ-বৈষম্য: 'কোন কর্ম, রীতিনীতি অথবা মনোভাবকে 'লিঙ্গ-বৈষম্যমূলক' বলা হবে যদি ওইসব যুক্তিহীনভাবে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি করে এবং অপ্রাসঙ্গিক পার্থক্যের উপর নির্ভর করে তাদের এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর ক্ষতিসাধন করে, তাদের শোষণ করে।' তাহলে ''লিঙ্গ-বৈষম্যবাদী' বলতে তাদের বোঝানো হয় যারা মনে করে যে, সমাজের নারী এবং পুরুষকে কেন্দ্র করে যে বৈষম্যমূলক মনোভাব, আচার-আচরণ, রীতিনীতি ইত্যাদি প্রচলিত আছে তার সঙ্গত এবং সমর্থনযোগ্য।
বর্তমান সমাজে লিঙ্গ-বৈষম্য: বর্তমান মানবসমাজে সব দেশেই লিঙ্গ-বৈষম্যমূলক মনোভাব অল্পবিস্তর লক্ষ্য করা যায়। এই বৈষম্যমূলক মনোভাবের জন্য আমরা সাধারনত মনে করি যে পরিসেবা(nurse) করলে সে নারী হবে, ডাক্তার হলে সে পুরুষ; ঘর মোছা, বাসন মাজার লোক হলে সে নারী হবে, মিস্ত্রী হলে পুরুষ হবে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেও এই বৈষম্য স্পষ্ট হয়; মেয়েদের বোধ সামর্থ্য ছেলেদের অপেক্ষা বেশি; ছেলেদের দেশ-প্রত্যক্ষণ সামর্থ্য মেয়েদের অপেক্ষা বেশি। এর থেকে আমাদের ধারণা মেয়েদের পাঠ্যবিষয় হবে মনস্তত্ত্ব, সাহিত্য, রন্ধনশিল্প ইত্যাদি। আর ছেলেদের পাঠ্যবিষয় হবে যন্ত্রশিল্প, প্রযুক্তি, চিকিৎসাবিদ্যা ইত্যাদি। মেয়েরা অন্তর্মুখী, ছেলেরা বহির্মুখী এবং আক্রমণপ্রবণ। মেয়েরা প্রসাধন বিলাসী, ছেলেরা প্রসাধন বিমুখ ইত্যাদি।
কেশ-বিন্যাস, বেশভূষা, চলা-বলা ও বসার ভঙ্গি দেখেই আমরা নারী ও পুরুষের মধ্যে সহজেই পার্থক্য করতে পারি। সমাজ অনুমোদিত এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে কেউ অনুসরণ না করলে আমরা তা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারিনা, কখনো ঠাট্টা-বিদ্রুপ করি, আবার কখনো শাস্তিমুলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করি। যেকোনো সভ্যসমাজে কোন স্ত্রী লোক পুরুষের পোশাকে বাইরে চলাফেরা করলে অপরের উপহাসের পাত্র হয় এবং কোনো পুরুষ যদি স্ত্রীলোকের পোশাকে চলাফেরা করে তাহলে সে কেবল উপহাসের বিষয় হয় না, শাস্তিযোগ্য অপরাধরূপেও গণ্য করা হয়।
লিঙ্গ-বৈষম্য অনুসারে এপ্রকার বেশ-বাসের বৈষম্যের জন্য অনেক সময় আবার আমাদের জীবনে এমন পরিস্থিতি দেখা দেয় যা পুরুষের কাছে অনুকূল হলেও স্ত্রীলোকের কাছে প্রতিকূল। পোশাকের ধরন ও চলন ভঙ্গি দেখেই যেখানে নারী অথবা পুরুষ চিহ্নিত করা যায় সেখানে গভীর রাতে একাকী বাড়ি ফেরার সময় কোন স্ত্রীলোকের পোশাক ও চলন ভঙ্গি হবে বিপদের কারণ --- তাকে পুরুষ অপেক্ষা বেশি অসহায় ও দুর্বল জেনে দুষ্কৃতীরা স্বভাবতই আক্রমণ করে।
সমাজের অপরাপর অনেক ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য ব্যবস্থার লক্ষ্য করা যায়। কোন আলোচনাচক্রে, যথা-- ব্যবসায়িক সভা-সমিতিতে স্ত্রীলোকের অভিমত অপেক্ষা পুরুষের অভিমতকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। সাধারণভাবে, পুরুষকে শক্তিমান রূপে এবং স্ত্রীলোককে অপেক্ষাকৃত দুর্বল রূপে গণ্য করা হয় এবং মনে করা হয় যে পুরুষের কাজ মূলত অর্থ উপার্জন, প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ ইত্যাদি, আর স্ত্রী লোকের কাজ মূলত সন্তানের পরিচর্যা ও গৃহকর্ম। পুরুষের কাছে পরিবার অপেক্ষা জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ বেশি কাম্য হবে, আর স্ত্রীলোকের কাছে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ অপেক্ষা তার পরিবার পরিচর্যা বেশি কাম্য হবে। আমাদের ব্যবহৃত ভাষাতেও এই লিঙ্গবৈষম্য পরিস্ফুট হয় --- ইংরেজিতে কোন পুরুষের পৌরুষ থাকলে বলি " He Man", আর স্ত্রীলোকের বলি "She"। সব ভাষাতেই সর্বনাম প্রয়োগের ক্ষেত্রে অথবা বিশেষণ প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই লিঙ্গ-বৈষম্য প্রকাশ পায়। যেমন- বাংলায় পুরুষকে বলি 'সুন্দর' স্ত্রীলোককে বলি 'সুন্দরী'।
কাজেই বর্তমান মানব সমাজে লিঙ্গ-বৈষম্য মূলক ব্যবস্থাদি যে এক বাস্তব ঘটনা, এটা অস্বীকার করা যায় না।
লিঙ্গ-বৈষম্যের উৎস: লিঙ্গ-বৈষম্যের উৎস কি? প্রশ্নটি বিতর্কিত।
উদারপন্থীদের মত: লিঙ্গ-বৈষম্যের মূলে মানুষের জন্মগতি নয়, তাহলো সামাজিক পরিবেশ। নারী এবং পুরুষের মধ্যে যে বৈষম্য করা হয় তা স্বভাবগত নয়, তা নেহাৎই কৃত্রিম, সমাজের সৃষ্টি। নারী ও পুরুষের মধ্যে যেখানে স্বভাবগত কোন প্রভেদ নেই সেখানে নারীর ওপর পুরুষের প্রাধান্য নৈতিক দিক থেকে অন্যায়, নৈতিক অপরাধ।
রক্ষণশীলদের মত: লিঙ্গ-বৈষম্য প্রকৃতিদত্ত, স্বভাবজ; কাজেই বৈষম্যমূলক মনোভাব, রীতিনীতি বা আচার-আচরণ অন্যায় বা অনুচিত নয়।