Tuesday 7 April 2020

উদারনীতিবাদ, মার্কসবাদ, ফ্যাসিবাদ ও গান্ধিবাদ বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর

উদারনীতিবাদ, মার্কসবাদ, ফ্যাসিবাদ ও গান্ধিবাদ বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১। উদারনীতিবাদ বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: প্রাচীনকালে গ্রিক দার্শনিকেরা ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে মত প্রচার করে উদারনীতিবাদের গােড়াপত্তন করেছেন। আধুনিক উদারনীতিবাদের সমর্থক হলেন জন স্টুয়ার্ট মিল। তিনি তার “On Liberty” গ্রন্থে বলেছেন,—“মানুষ তার নিজের ওপর, তার দেহ ও মনের ওপর সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিশেষ করে মানুষের আত্মকেন্দ্রিক কাজের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়।
উদারনীতিবাদ বর্তমানে একটি জনপ্রিয় মতবাদ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ল্যাস্কি বলেছেন, ইউরােপের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সময় উদারনীতিবাদের জন্ম হয়। বিশ শতকের প্রথম দিকে এর গুরুত্ব কিছুটা কমে যায়। বর্তমানে মার্কসবাদের বিরুদ্ধে একটা বড়াে চ্যালেঞ্জ হিসাবে এই মতবাদ আত্মপ্রকাশ করেছে।
উদারনীতিবাদ বা Liberalism শব্দটি লাতিন শব্দ Liber থেকে এসেছে। Liber কথাটির অর্থ হল স্বাধীন। সুতরাং, উদারনীতিবাদের অর্থ হল—ব্যক্তিস্বাধীনতার মতবাদ। যে মতবাদ ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধীন মত প্রকাশের উপর গুরুত্ব আরােপ করে, স্বাধীনতার অধিকার ও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে অধিকার প্রভৃতিকে ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রধান উপায় বলে মনে করে, তাকে বলা হয় উদারনীতিবাদ।
এই মতবাদ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সােচ্চার হয়েছে। আবার মানুষের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরােপ করেছে।
প্রশ্ন ২। উদারনীতিবাদের মূল নীতি বা বৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে।
উত্তর: উদারনীতিবাদকে প্রধানত দু-ভাগে ভাগ করা যায়। সনাতনী উদারনীতিবাদ ও আধুনিক উদারনীতিবাদ। এই উভয়ের সমন্বয়ে উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য বা নীতিগুলি বর্ণনা করা হলঃ
(ক) ব্যক্তিস্বাধীনতা:
উদারনীতিবাদ ব্যক্তির স্বাধীনতার ওপর বেশি গুরুত্ব আরােপ করে। উদারনীতিবাদ স্বাধীনতার ওপর কোনাে নিয়ন্ত্রণের পক্ষপাতী নয়। কারণ, এই মতবাদ মনে করে নিয়ন্ত্রণ থাকলে ব্যক্তির বিকাশ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় না।
(খ) ব্যক্তিগত সম্পত্তি:
উদারনীতিবাদ নাগরিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর গুরুত্ব আরােপ করে। কারণ, ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকলে নাগরিক কাজকর্মে উৎসাহ পায়। ফলে দেশে অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটে।
(গ) রাজনৈতিক সাম্য:
উদারনীতিবাদ রাজনৈতিক সাম্যনীতির ওপর গুরুত্ব আরােপ করে। অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সকলে সমান অধিকার পাবে। এই সাম্যনীতির প্রেক্ষাপটে সরকারের লক্ষ্য হবে সব মানুষের কল্যাণসাধন করা।
(ঘ) নিরপেক্ষ আদালত:
উদারনীতিবাদ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি নিরপেক্ষ আদালত রাখার পক্ষপাতী। এই আদালত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা ও সংবিধানের ব্যাখ্যা করে।
(ঙ) বহুদলীয় ব্যবস্থা:
উদারনীতিবাদীরা গণতন্ত্রে একাধিক দল রাখার পক্ষপাতী। একাধিক দল থাকলে জনগণ স্বাধীনভাবে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে সক্ষম হয়। বিরােধীদল সরকারের সমালােচনা করে তাঁর স্বৈরাচারী কার্যকলাপে
বাধা দান করে।
(চ) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা:
উদারনীতিবাদীরা উদারনৈতিক ক্ষেত্রে সকলের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তারা অবাধ বাণিজ্যনীতি সমর্থন করে। তারা অর্থনৈতিক কাজকর্মের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের পক্ষপাতী নয়।
(ছ) শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিবর্তন:
উদারনীতিবাদ বিপ্লবের পথে সমাজের পরিবর্তন চায় না। তারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে বুলেটের পরিবর্তে ব্যালটের মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তন করতে চায়।
(জ) ধর্মনিরপেক্ষতা:
উদারনীতিবাদের আর একটি গুরুত্বপূণ নীতি হল, ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হল- প্রত্যেকে তার বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্ম পালন করবে। রাষ্ট্র কোনাে বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা সুযােগসুবিধা প্রদান করবে না।
(ঝ) সার্বিক ভােটাধিকার:
উদারনীতিবাদে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের নীতি স্বীকৃত হয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ,  ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই স্বাধীনভাবে ভােট দিতে পারে।
(ঞ) গণমাধ্যমের স্বাধীনতা:
উদারনীতিবাদ সংবাদপত্র, বেতার, দূরদর্শন প্রভৃতি গণসংযােগের মাধ্যমগুলির স্বাধীনতা স্বীকার করে।
এই স্বাধীনতার ফলে তারা সরকারের কাজের সমালােচনা করতে পারে। তাতে সরকার সংযত হয়ে চলতে চেষ্টা করবে। ফলে জনগণ সরকারের কাছ থেকে সঠিক সেবা পায়।
প্রশ্ন ৩। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উদারনীতিবাদের গুরুত্ব কী ?
উত্তর: উদারনীতিবাদ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক তত্ত্ব। এই তত্ত্বে আছে এক বিশাল ঐতিহ্য। সমাজতান্ত্রিক
সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ধ্বংসস্তুপ থেকে যে গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠতে শুরু করে তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল উদারনীতিবাদ। এই মতবাদ সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার তুলনায় অনেক বেশি প্রগতিশীল। ড: অমল মখােপাধ্যায়ের মতে, “ইউরােপীয় ইতিহাসের এক বিশেষ পর্বে উদারনীতিবাদ ব্যাপক পরিবর্তনের বিশুদ্ধ বাতাস নিয়ে এসেছিল।” উদারনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয়। এই তত্ত্বের প্রভাবে মানুষ অন্ধ বিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তিবাদী হতে শুরু করে। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অন্যান্য অধিকার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। এই মতবাদের ফলে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
প্রশ্ন ৪। উদারনীতিবাদকে কোন কোন দিক থেকে সমালােচনা করা যায়?
উওর: মার্কসবাদীরা বিভিন্ন দিক দিয়ে উদারনীতিবাদের সমালােচনা করেছেন।
প্রথমত, উদারনীতিবাদ রাজনৈতিক সাম্যের কথা বলেছেন কিন্তু অর্থনৈতিক সাম্যের কথা বলেনি। অধ্যাপক ল্যাস্কি বলেছেন,—অর্থনৈতিক সাম্য ছাড়া রাজনৈতিক সাম্য ও অধিকার অর্থহীন।
দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে স্বীকার করার ফলে বিত্তশালীরাই জনমত গঠনের মাধ্যমগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। সেজন্য এখানে প্রকৃত জনমত গড়ে উঠতে পারে না।।
তৃতীয়ত, এখানে বিচারকেরা উচ্চবিত্ত শ্রেণি থেকে আসে। তাদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায়বিচার আশা করা যায় না। কারণ, নিজের জীবনে দারিদ্র্য না থাকলে দারিদ্র্যের জ্বালা বােঝা কষ্টকর।
চতুর্থত, উদারনীতিবাদীরা রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে সীমিত করতে চায়। অথচ ব্যক্তির বিকাশের জন্য যে পরিবেশ দরকার, রাষ্ট্র তা সৃষ্টি করতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে।
পঞ্চমত, উদারনীতিবাদীরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বীকার করে। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করে। সমাজে বৈষম্য থাকলে সাম্য ও স্বাধীনতার আদর্শ রূপায়িত হতে পারে না।
প্রশ্ন ৫। মার্কসবাদের উৎস সম্পর্কে একটি টীকা লেখাে।
উত্তর: কোনাে মতবাদ বা দর্শনই স্বয়ম্ভু নয়। মার্কসবাদ একটি বস্তুবাদী দর্শন। মার্কসবাদের সুনির্দিষ্ট পটভূমি বা উৎস রয়েছে। মার্কস তাঁর পূর্ববর্তী বহু লেখক, তাত্ত্বিক, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, এবং অর্থনীতিবিদদের রচনা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে তাঁর তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এক্ষেত্রে মার্কস-এর ভাবশিষ্য লেনিনের বক্তব্যই বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ও গ্রহণযােগ্য বলে বিবেচিত হয়।
লেনিনের ভাষায়, ‘মার্কস-এর দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষামালার নাম মার্কসবাদ। জার্মান চিরায়ত দর্শন, ইংরেজ চিরায়ত অর্থশাস্ত্র এবং ফরাসি সমাজতন্ত্র তথা সাধারণভাবে ফরাসি বিপ্লবের মতবাদ মানবজাতির সবচেয়ে অগ্রসর তিনটি দেশে আবির্ভূত উনিশ শতকের এই তিনটি প্রধান ভাবাদর্শগত প্রবাহের ধারাবাহিক ও প্রতিভাধর পূর্ণতা সাধক হলেন মার্কস। লেনিনের আরও অভিমত হল, উনিশ শতকের জার্মান দর্শন, ইংরেজ অর্থশাস্ত্র এবং ফরাসি সমাজতন্ত্ররূপে মানবজাতির যা শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, তার ন্যায়সংগত উত্তরাধিকারই হল মার্কসবাদ। প্রকৃতপক্ষে, মার্কসীয় তত্ত্বের প্রধান প্রধান উপকরণগুলি সংগৃহীত হয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর জার্মান, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স থেকে। মার্কস তাঁর ‘উদ্বৃত্তমূল্য সংক্রান্ত তত্ত্ব ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো প্রমুখদের কাছ থেকে শ্রেণিসংগ্রাম, রাষ্ট্র ও বিপ্লবসংক্রান্ত তত্ত্ব ফরাসি সমাজতন্ত্রীদের থেকে এবং দ্বন্দ্ববাদ ও বস্তুবাদ সংক্রান্ত ধারণা জার্মান ভাববাদী দার্শনিক হেগেল প্রমুখদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন। তাই বলে মার্কসবাদ মৌলিকত্ববিহীন নয়। মার্কস বিভিন্ন উপাদানগুলিকে সম্পূর্ণভাবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারবিশ্লেষণ করেছেন এবং এক নতুন বস্তুবাদী দর্শনের জন্ম দিয়েছেন।
প্রশ্ন ৬। মার্কসীয় বিপ্লব তত্ত্বের একটি টীকা লেখাে।
উত্তর: উদারনৈতিক বুর্জোয়া দার্শনিকদের মতে বিপ্লব হল, অভ্যন্তরীণ সংঘাতপূর্ণ ঘটনার মাধ্যমে দেশের শাসনব্যবস্থার হিংসাত্মক ও আকস্মিক পরিবর্তন। কিন্তু মার্কসীয় দর্শনে বিপ্লবকে একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতি হিসাবে গণ্য করা হয়। বিপ্লবের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন ঘটে, একটি শাসকশ্রেণির পতন ঘটিয়ে নতুন এক শাসকশ্রেণির উদ্ভব হয়। মার্কসীয় চিন্তাধারা অনুসারে, যে- কোনাে শ্রেণিবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণিস্বার্থের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল শ্রেণির স্বার্থে সমাজব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন হল বিপ্লব। অন্যভাবে বলা যায়, বিপ্লব হল পুরাতন একটি শ্রেণির হাত থেকে নতুন একটি শ্রেণির হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তান্তর অর্থাৎ প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের ধারক শাসক শ্রেণিকে উৎখাত করে নতুন প্রগতিশীল শ্রেণি কর্তৃক, ক্ষমতা দখল এবং নতুন একটি উৎপাদন সম্পর্কের সৃষ্টিই হল বিপ্লব। মার্কস বিপ্লবকে ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসাবে অভিহিত করেছেন। লেনিন বিপ্লবের জন্য দু-ধরনের শর্তের কথা বলেছেন। এই শর্ত দুটি হল—বিষয়ীগত অবস্থা এবং বিষয়গত অবস্থা। বিপ্লবের ‘বিষয়গত অবস্থা’ বলতে জনগণের বিপ্লবী চেতনা, সংগ্রামী মানসিকতা, দৃঢ়তা, উপযুক্ত সংগঠন, নির্ভুল রণনীতি ও রণকৌশল ইত্যাদিকে বুঝিয়েছেন। বিষয়গত এবং বিষয়ীগত উপাদানের সংযুক্ত অবস্থানের মাধ্যমেই বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং সফল হয়। মার্কসীয় বিপ্লব তত্ত্বটি উদারনৈতিক রাষ্ট্র দার্শনিকদের দ্বারা বিভিন্ন ভাবে সমালােচিত হলেও, মার্কসীয় বিপ্লবতত্ত্ব সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি উদ্দীপক হিসাবে কাজ করেছে—এ কথা সকলেই স্বীকার করেন।
Comment

Class XI Political Science

Class XII Political Science

Class 12 Bangla Books Question& Answers