Tuesday, 7 April 2020

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কয়েকটি মৌলিক ধারণা বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কয়েকটি মৌলিক ধারণা

প্রশ্ন ১) শক্তি বলতে কী বােঝ?

উত্তর : আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে শক্তি (Power) এক প্রাধান্যমূলক ভূমিকা গ্রহণ করে। অনেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে শক্তি রাজনীতি (Power politics) বলেই উল্লেখ করেছেন। সকল সার্বভৌম রাষ্ট্র তার অস্তিত্বের জন্যে জাতীয় শক্তির ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় রাষ্ট্র কী ধরনের ভূমিকা গ্রহণ করবে তা অনেকাংশে তার জাতীয় শক্তির ওপর নির্ভরশীল। শুম্যান (E. L. Schuman) বলেছেন, শক্তির জন্যে বা ক্ষমতার জন্যে লড়াই হল রাজনীতি (All politics is a struggle for power)। অধ্যাপক মরগেনথউ (Moryzenthau) বলেছেন, সকল রাজনীতি ক্ষেত্রের মতাে আন্তর্জাতিক রাজনীতিও হল শক্তির জন্য লড়াই।
     শক্তি বলতে বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন বিষয় বােঝান। শক্তির সংজ্ঞা সম্পর্কে তাই ঐকমত্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়। হানস মরগেনহাউ-এর (Hans Morgenthau) মতে, অন্যের মন ও কাজের ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা হল শক্তি (Power of man over the minds and actions of other men)। মানুষের ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ হল শক্তি। শক্তির সঙ্গে অনেকে বলপ্রয়ােগের পার্থক্য করে থাকেন। বলপ্রয়ােগ বলতে শুধু সামরিক শক্তি বােঝায়, কিন্তু শক্তির ধারণা ব্যাপকতর। বলপ্রয়ােগ বা বলপ্রয়ােগের ভীতি প্রদর্শন ছাড়াও শক্তির অন্যান্য ইতিবাচক ও অহিংস পদ্ধতিও আছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তববাদী (Realist school) দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকগণ শক্তিকে, উপায় ও লক্ষ্য বলে মনে করেন। কোনাে রাষ্ট্রের লক্ষ্য হল অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষা। শক্তি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষায় সাহায্য করে। এই অর্থে শক্তি রাষ্ট্রের লক্ষ্য।

প্রশ্ন ২) ক্ষমতার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে।

উত্তর : ক্ষমতার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
ক্ষমতা হল একটি সম্পর্ক
অধ্যাপক অ্যালান বল তাঁর ‘Modern Politics & Government’ গ্রন্থে রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। বলের মতে রাজনৈতিক ক্ষমতা হল এক ধরনের সম্পর্ক ক্ষমতাকে যিনি ধারণ করে আছেন তিনি বিভিন্ন শক্তির ভয় দেখিয়ে অনিচ্ছুক ব্যক্তির ওপর প্রভাব খাটিয়ে নিজের নির্দেশ পালনে বাধ্য করবেন। বল উল্লেখ করেছেন যে, ফ্রাইডে নামক ব্যক্তিটি দ্বীপে না আসা পর্যন্ত রবিনসন ক্রুসাের কোনাে ক্ষমতা ছিল না।
     সাধারণত রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতি আনুগত্যের উৎস হল শক্তির ভয়। সম্মান ও সম্পদের প্রলােভন রাজনৈতিক ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। অধিকাংশ সময়েই রাজনৈতিক আধিকারিকগণ আনুগত্য আদায়ের জন্য ভীতি প্রদর্শন বা শাস্তিদানের পদ্ধতি গ্রহণ করেন।
     অধ্যাপক বল বিষয়টির অন্য একটি দিকের উত্তরণ ঘটিয়েছেন। বিষয় হল ‘কে’ বা ‘কী’ ক্ষমতা রয়েছে’? যদি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশমতাে কোনাে মন্ত্রী পদত্যাগ করেন এবং এর ফলে মন্ত্রীসভা সংকটে পড়ে, তাহলে স্বীকার করতে হবে যে প্রধানমন্ত্রী হলেন প্রকৃত ক্ষমতাশালী।
সুতরাং, ক্ষমতার সম্পর্ক নিরূপণের সমস্যা রয়েছে। বলের মতে, রাজনৈতিক ক্ষমতা হল এক ধরনের সম্পর্ক এবং এই সম্পর্ক সব সময় সুস্পষ্ট নয়।
ক্ষমতা হল আচরণমূলক
রাজনৈতিক ক্ষমতাকে একটি সম্পর্ক হিসাবে বিবেচনা করলে, দেখা প্রয়ােজন যে কার ওপর এবং কী সম্পর্কে কোনাে ব্যক্তির ক্ষমতা বর্তমান। ক্ষমতা হল পরিবর্তনশীল। এই কারণে কোনাে রাজনৈতিক পদাধিকারীর ক্ষমতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সমকালীন ব্যক্তিবর্গের আচরণকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে তাঁর সামর্থ্যের বিষয়টি আলােচনা করা আবশ্যক।
     রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়ােগপদ্ধতি পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিপ্রেক্ষিতে আচরণ ও কাজকর্মের কাছে রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কযুক্ত। পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়ােগপদ্ধতিও পরিবর্তিত হয়।
বল যথার্থই বলেছেন, কোনাে রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই ক্ষমতা সুষ্ঠুভাবে বন্টিত হয় না। সেই কারণেই রাজনৈতিক ক্ষমতা কতিপয়ের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে।

প্রশ্ন ৩) জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা দাও।

উত্তর : পল সিবিউরি (Pawl Seabory) জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে তিনটি অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন।
প্রথমত, তাঁর মতে, জাতীয় স্বার্থ বলতে একটি আদর্শ স্থানীয় উদ্দেশ্যের সমষ্টিকে বােঝায়।
দ্বিতীয়ত, বর্ণনাত্মক অর্থে জাতীয় স্বার্থ হল সেইসব উদ্দেশ্যের সমন্বয় যা প্রতিটি জাতি তার নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে নিরন্তর অনুসরণ করে।
তৃতীয়ত, জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে গােষ্ঠী এবং ব্যক্তির মধ্যে যে বিরােধ সৃষ্টি হতে পারে তার প্রতিও সিবিউরি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
     জর্জ কেন্নান (Kennan)-এর মতে, বস্তুত, আমরা যা জানতে এবং অনুধাবন করতে পারি তাকেই জাতীয় স্বার্থ নামে অভিহিত করা হবে। হলসটির মতে অনেক সময়ে জাতির লক্ষ্য ব্যাখ্যার মাধ্যমরূপে জাতীয় স্বার্থের ধারণা প্রয়ােগ করা হয়। তিনি মনে করেন যে, জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে কোন্ কোন্ বিষয় যুক্ত থাকবে এই বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিতে পারে।
      অধ্যাপক মরগেনথাউ রাজনৈতিক বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি জাতীয় স্বার্থের বিশ্লেষণে নৈতিক, মতাদর্শগত এবং আইনানুগ মানদণ্ড গ্রহণের বিরােধী। তিনি জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে প্রধান চিহ্ন প্রদানকারী স্তম্ভরুপে বর্ণনা করেছেন। মরগেনথাউ –এর মতে, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল বিষয়বস্তু জাতীয় স্বার্থের ধারণার মধ্যেই নিহিত।
যে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির মধ্যে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয়, তার ওপরই স্বার্থের ধারণা নির্ভরশীল। মরগেনথাউ -এর মতে জাতীয় স্বার্থের ধারণার সঙ্গে আস্তিত্বের বিষয় জড়িত। এই অস্তিত্ব বলতে তিনি কোনাে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের ভৌগােলিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে অন্য রাষ্ট্রের আক্রমণের হাত থেকে আত্মরক্ষার প্রয়ােজনীয়তা বুঝিয়েছেন।

প্রশ্ন ৪) জাতীয় স্বার্থের লক্ষ্যগুলি আলােচনা করাে।

উত্তর : জাতীয় স্বার্থের ধারণা নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এই কারণে রাষ্ট্রীয় লক্ষ্যের পরিবর্তনের ফলে জাতীয় স্বার্থের প্রকৃতিগত পরিবর্তন ঘটতে পারে। সাধারণত জাতীয় স্বার্থের লক্ষ্যরূপে আত্মরক্ষা জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় কল্যাণ, মর্যাদা, শক্তি সংরক্ষণ, মতাদর্শগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা ও প্রবণতাকে উল্লেখ করা হয়। জাতীয় সার্বভৌমত্ব, সংহতি এবং ভূখন্ডগত অখণ্ডতা রক্ষার পরেই কোনাে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের কল্যাণসাধনে ব্রতী হতে পারে। জাতীয় বৃদ্ধি ও প্রভাব বিস্তার হল পরবর্তী লক্ষ্য। মতাদর্শগত লক্ষ্য ও জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। পুঁজিবাদের সঙ্গে সাম্যবাদের বিরােধ আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে জটিল করে তুলছে। আগ্রাসন পরিহার ও প্রতিরােধ, শান্তি প্রতিষ্ঠা, নিরস্ত্রীকরণ, আন্তর্জাতিক সহযােগিতার সম্প্রসারণ, বিরােধ দূরীকরণ, কোনাে বিশেষ মতাদর্শের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা হল জাতীয় স্বার্থের লক্ষ্য। তবে প্রত্যেক জাতির জাতীয় স্বার্থের ধারণার সঙ্গে জাতির অস্তিত্ব রক্ষার বিবেচনাই প্রাধান্য অর্জন করে।
     জাতীয় স্বার্থের ধারণার ভিত্তিতেই পারস্পরিক আলাপ-আলােচনা হয়ে থাকে। কোনাে রাষ্ট্রনেতা তখনই অন্য কোনাে রাষ্ট্রকে সুযােগসুবিধা দানের বিষয়ে বিবেচনা করেন যখন তিনি এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হন যে, এই পদ্ধতির মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে তাঁর জাতীয় স্বার্থকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
     আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কে জাতীয় স্বার্থের ধারণাই নির্ধারকের ভূমিকা গ্রহণ করে। যুদ্ধ ও শান্তির সময়ে সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠন, অর্থনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক প্রত্যেকটি বিষয়ই জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যেসব সামরিক ও অর্থনৈতিক জােট গঠিত হয়েছিল, তাদেরও মূল লক্ষ্য ছিল নিজ জাতীয় স্বার্থকে সুরক্ষিত এবং প্রসারিত করা। একইভাবে সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ইউরােপের সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ নিজেদের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত এবং অর্থনৈতিক সমস্যাসমাধানের জন্য যথাক্রমে ‘ওয়ারশ চুক্তি’ (Warshaw pact) এবং ‘কোমেন’ (Comecon) গঠনের ক্ষেত্রে উদ্যোগী হয়েছিল। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানির সামরিক জোট রয়েছে। নিরস্ত্রীকরণ, আণবিক মারণাস্ত্রের প্রসার রােধের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ, মারণাস্ত্রের সীমিতকরণ ইত্যাদি বিষয় জাতীয় স্বার্থের ধারণার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। ভূখণ্ড-কেন্দ্রিক রাষ্ট্র গঠনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কোনাে রাষ্ট্রের পক্ষেই জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে ত্যাগ করা সম্ভব হয়নি।
সুতরাং, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বাস্তব মূল্যায়নের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, জাতীয় স্বার্থের ধারণা পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

প্রশ্ন ৫) ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে বান্দুং সম্মেলনের ভিত্তিতে জোটনিরপেক্ষতার ধারণাটি বিবৃত করাে।

উত্তর : বান্দুং সম্মেলনে মূলত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ‘পঞ্চশীলনীতি’ রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব, অনাক্রমণ, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, সমানাধিকার ও সহাবস্থান প্রবলভাবে সমর্থিত হয়। জোটনিরপেক্ষতার নীতি জোরালােভাবে সমর্থন করেন।
• জোটনিরপেক্ষতা তথাকথিত ‘নিরপেক্ষতার’, (Neutrality) ধারণা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। আন্তর্জাতিক আইনে নিরপেক্ষতার (Neutrality) অর্থ হল যুদ্ধে বিবদমান রাষ্ট্রগুলি থেকে দূরে থাকা। কিন্তু জোটনিরপেক্ষতার অর্থ নির্লিপ্ততা বা ঔদাসীন্য নয়, নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক। জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলি সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ঠান্ডা লড়াই’ (Cold war)-এর আবহাওয়ায় আন্তর্জাতিক সমস্যার বিচার করবে প্রতিটি সমস্যার প্রকৃতি বিচার করে, জোটের মুখাপেক্ষী হয়ে নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উত্তেজনা প্রশমনই জোটনিরপেক্ষতার মূল লক্ষ্য।
• সামরিক জোটগুলি সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে বিশেষ নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য করে। তাই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্যে কোনাে সামরিক জোটে অংশগ্রহণ করা চলবে না। জোটনিরপেক্ষতা সামরিক চুক্তি ও মারণাস্ত্রের বিরােধিতা করে। নিরস্ত্রীকরণের (Disarmament) ওপর জোটনিরপেক্ষতা প্রথম অবস্থা থেকেই বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করে আসছে।
• বর্ণবাদ, উপনিবেশবাদ আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযােগিতার পথে বিরাট প্রতিবন্ধক। সাম্রাজ্যবাদ ও অসাম্যের বিরুদ্ধে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির নেতৃবৃন্দ প্রথম অবস্থা থেকে কঠোর মনােভাব গ্রহণ করেন এবং এর অবসানের জন্যে প্রয়াসী হন।
• সামরিক জোটের বিরােধী হলেও জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি নিজেরা কোনাে পৃথক জোট গঠন করবে না। আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে সহযােগিতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ এক বিশ্ব গড়ে তােলার জন্যে এবং লক্ষ্যগুলি পূরণের নিরন্তর প্রয়াস চালাবে। পঞ্চাশের দশকের মধ্যবর্তী সময় থেকে জোটনিরপেক্ষতা একটি আন্দোলনের রূপ (NAM) পরিগ্রহ করে এবং আন্দোলন ক্রমশ প্রসার লাভ করে।

প্রশ্ন ৬) ‘বিশ্বায়ন’ বলতে কী বােঝ?

উত্তর : বর্তমানে উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ এবং বিশ্বায়ন কথাগুলি আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে ৮০-র দশক থেকেই অত্যন্ত পরিচিত। অধ্যাপক অমিয়কুমার বাগচি বলেছেন, “বিশ্বায়ন’ (Globalisation) কথাটা এত বিভিন্ন অর্থে এবং এত বিভিন্ন প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয় যে তার কোনাে সর্বজনগ্রাহ্য অভিধা তৈরি করার চেষ্টা এখনও পর্যন্ত বৃথাশ্রম বলেই মনে হয়। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, জ্ঞান ও বিজ্ঞান সমস্ত ক্ষেত্রেই বিশ্বায়নের প্রভাব বিভিন্ন বক্তা ও লেখক লক্ষ করেছেন। বৈষয়িক ক্ষেত্রে ‘বিশ্বায়ন’ কথাটি অন্তত দুটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। এক অর্থে বিশ্বায়ন একটি জগদব্যাপী প্রক্রিয়া বা প্রক্রিয়া সমষ্টির সংজ্ঞা। সেই অর্থে বিশ্বায়ন বহিঃপ্রকৃতির বা আর্থিক জগতের অন্য যে-কোনাে প্রক্রিয়া সমষ্টির মত বর্ণনা বা বিশ্লেষণের ব্যাপার—বিশ্লেষক সেখানে নির্লিপ্ত গবেষক বা দর্শকমাত্র। বিশ্বায়নের দ্বিতীয় সংজ্ঞা—কতকগুলি নির্দিষ্ট আর্থিক বা বৈষয়িক নীতির সমাহার, যে নীতিগুলি গ্রহণ করলে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া তরান্বিত হতে পারে।

প্রশ্ন ৭) বিশ্বায়নের আড়ালে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির আর্থিক সংস্কারের নামে যেসব কঠিন শর্ত চাপানাে হয়েছে তা আলােচনা করাে।

উত্তর : তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির আর্থিক সংকট থেকে মুক্তির জন্য বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডার ঋণ মঞ্জুরের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি কঠিন শর্ত আরােপ করে।
এই শর্তগুলি নিম্নরূপ-
• ব্যাপকভাবে সরকারি ব্যয়সংকোচ এবং সরকারি খরচ কমিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অন্যান্য সরকারি ব্যবস্থাকে বেসরকারিকরণ করে ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতে চালাতে হবে।
• রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র ভেঙে দিয়ে বেসরকারি মালিকদের কাছে বিক্রি করতে হবে-ব্যাংক, বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে সবকিছুই।
• সরকারি কর্মচারী সংখ্যা হ্রাস করতে হবে এবং সরকারি বিভাগও বেসরকারি করতে হবে।
• রুণশিল্প বন্ধ করে দিতে হবে এবং সব শিল্পে ব্যাপকহারে কর্মী ছাটাই করতে হবে।
• শিল্প, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে সব সামাজিক কাজকর্ম হবে মুনাফাভিত্তিক।
• দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে হবে।
• আমদানির ওপর বিধিনিষেধ সম্পর্ণ তুলে দিয়ে পশ্চিমি দেশগুলির উৎপাদিত সামগ্রী আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে।
• বহুজাতিক কোম্পানিগুলিকে ওইসব দেশে ব্যাপকভাবে প্রবেশের সুযােগ করে দিতে হবে।
• বহুজাতিক কর্পোরেশনের শােষণে যাতে কোনাে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয় সেজন্যে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার খর্ব করতে হবে। এই মারাত্মক শর্তগুলির জন্যে তৃতীয় বিশ্বের জনগণ চরমভাবে শােষিত হচ্ছে এবং ওইসব দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা শুধু নয় রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হচ্ছে।

প্রশ্ন ৮) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষমতার গুরুত্ব বর্ণনা করাে।

উত্তর : আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শক্তি ছাড়া কোনাে রাষ্ট্র তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বহুলাংশে এই ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রমাত্রই কতকগলি বিষয় বা মূল্যবােধ বজায় রাখতে ও বিস্তৃত করতে চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে সম্মান, শান্তি ন্যায়নীতি, নিরাপত্তা, মর্যাদা প্রভৃতির কথা বলা যায়। ক্ষমতা ব্যতিরেকে এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করা যায় না। রাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতার ধারণা অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কযুক্ত। ক্ষমতা হল এক উপায় বা মাধ্যম বিশেষ ; এর সাহায্যে রাষ্ট্র তার স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র নীতি প্রয়ােগ করে। রাষ্ট্রে সবার জন্য শক্তির প্রয়ােজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। এর মধ্যেই নিহিত আছে জাতীয় শক্তির নৈতিক ভিত্তি। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ত্বের মূল হল এই ক্ষমতা বা শক্তি।

প্রশ্ন ৯) জোটনিরপেক্ষতার গুরুত্ব আলােচনা করাে।

উত্তর : জোটনিরপেক্ষতা তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া স্বাধীন দেশগুলিকে কোনাে আন্তর্জাতিক শক্তির কাছে মাথা নত না করে জগৎসভায় নিজেদের স্বাধীন, সার্বভৌম অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার সুযােগ করে দিয়েছে। তা ছাড়া জোটনিরপেক্ষতাকে আশ্রয় করেই তারা নিজেদের জাতীয় শক্তির সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। আরও উল্লেখ্য যে, আন্তর্জাতিক স্তরে নিজেদের মতামত অবাধে ব্যক্ত করার জন্য নির্জোট আন্দোলনের সুবাদে তারা একটি স্থায়ী মঞ্চ পেয়েছে। তা ছাড়া সােভিয়েত ইউনিয়নের পতন, ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান ও পরিবর্তিত বিশ্বরাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই কারণেই ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের বেলগ্রেড সম্মেলনে যেখানে মাত্র ২৫টি দেশ যােগদান করেছিল আজ সেই সংখ্যা ৪ গুণেরও বেশি। এইসব কারণেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জোটনিরপেক্ষতা আজ এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

প্রশ্ন ১০) আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নির্জোট আন্দোলনের অবদান সংক্ষেপে আলােচনা করাে।

উত্তর : আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নির্জোট আন্দোলন নানাভাবে অবদান রেখেছে। যেমন—
(ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোটনিরপেক্ষতা এক নতুন মাত্রা এনেছে। ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচনায় তা এক নতুন আলােচ্য বিষয় হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে।
(খ) নির্জোট আন্দোলনের সুবাদে তৃতীয় বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছে এবং একই সঙ্গে বিশ্বরাজনীতিতে এক বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে।
(গ) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসানে নির্জোট আন্দোল এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
(ঘ) বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে নির্জোট আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে সংগ্রাম করেছে। বস্তুত, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য নীতির তীব্র বিরােধিতা করে এবং এই বিরােধিতার অনুকূলে বিশ্বজনমত গঠন করে নির্জোট আন্দোলন এমনই এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যে, দক্ষিণ আফ্রিকা, শেষ পর্যন্ত এই নীতি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
(ঙ) দুর্বল রাষ্ট্রগুলির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির গায়ের জোরে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নির্জোট আন্দোলন সব সময়েই প্রতিবাদ জানিয়েছে। এতে কোনাে কোনাে সময়ে বিশ্বরাজনীতিতে উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছে এবং দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধ সংঘর্ষের সম্ভাবনাও কমেছে।
(চ) এই আন্দোলন গােড়া থেকেই প্রত্যেকটি নয়া উপনিবেশবাদী পদক্ষেপের বিরােধিতা করেছে। একই সঙ্গে নয়া উপনিবেশবাদী শােষণ থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করার জন্য নির্জোট আন্দোলনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে নানারকম ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানাে হয়।

প্রশ্ন ১১) নির্জোট আন্দোলনের সমস্যাগুলি সংক্ষেপে আলােচনা করাে।

উত্তর : নির্জোট আন্দোলনের সমস্যাগুলি প্রধানত এইরকম—
(ক) অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে অনেক সদস্যরাষ্ট্রে এমনই জটিলতার সৃষ্টি করেছে যে, পূর্ণশক্তিতে নির্জোট আন্দোলনে মদত দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
(খ) কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের পারস্পরিক সংঘাতে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। বলাবাহুল্য, এতে নির্জোট আন্দোলনের ঐক্য ও শক্তি ক্ষুন্ন হয়েছে।
(গ) নানা প্রস্তাব ও পরিকল্পনা সত্ত্বেও জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির মধ্যে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সহযােগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। ফলে তারা পরস্পরের খুব কাছাকাছি আসতে পারেনি।
(ঘ) জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির মধ্যে বিবাদ ও সংঘর্ষের ঘটনাও অনেক ঘটেছে। যেমন—কাম্পুচিয়ার উপর ভিয়েতনামের আক্রমণ, ইরান-ইরাক যুদ্ধ, পাক-ভারত বিবাদ ও সংঘর্ষ ইত্যাদি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা নির্জোট আন্দোলনকে দুর্বল করেছে।
(ঙ) এই অনৈক্য ও দুর্বলতার জন্যই সাম্প্রতিককালে বিশ্ব বাণিজ্যসংস্থা প্রণীত বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে নির্জোট আন্দোলন কোনাে সংঘবদ্ধ প্রতিরােধ গড়ে তুলতে পারেনি। একইভাবে পারমাণবিক অস্ত্রপরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ চুক্তির বৈষম্যমূলক ও আপত্তিকর ধারাগুলির বিরুদ্ধেও নির্জোট আন্দোলন রুখে দাঁড়াতে পারে নি।
Comment

Class XI Political Science

Class XII Political Science

Class 12 Bangla Books Question& Answers