Tuesday, 7 April 2020

আইন, স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায় বিচার বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর

আইন, স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায় বিচার
প্রশ্ন ১) আইনের সংজ্ঞা দাও।
উত্তর: সাধারণভাবে আইন বলতে কোনাে নির্দিষ্ট নীতি-নিয়ম বােঝায় যা স্বাভাবিকভাবে সকলে মান্য করে চলে। প্রাকৃতিক জগতের ঘটনাবলির মধ্যে যে কার্যকরণ সম্পর্ক দেখা যায় তার পেছনেও নির্দিষ্ট নিয়ম থাকে। তা বৈজ্ঞানিক বিধি (Scientific Laws) বলে পরিচিত। সামাজিক মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্যও নিয়মকানুন রয়েছে। মনের চিন্তা, ধ্যানধারণা, ন্যায়-অন্যায়, সৎ-অসৎ প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নিয়মকে নৈতিক বিধি (Moral Laws) বলে অভিহিত করা যায়। সমাজবদ্ধ মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করবার নিয়মকানুন সামাজিক আইন বা রাজনৈতিক আইন বলে অভিহিত করা হয়। সামাজিক প্রথা, ঐতিহ্য, ফ্যাশান, আচার-ব্যবহারের মধ্যে সামাজিক আইনের (Social Laws) প্রকাশ হয়। সামাজিক আইনের পিছনে জনমতের সমর্থন থাকে এবং সামাজিক আইন অমান্য করলে নিন্দাভাজন হবার ও সামাজিক ধিক্কার বা সমাজচ্যুতির আশঙ্কা থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক আইন রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট ও বলবৎ হয়ে থাকে; এটি অমান্য করলে নির্দিষ্ট শাস্তির ব্যবস্থাও থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রের সৃষ্ট এই আইনই প্রধান আলােচ্য বিষয়।
     আইনের সংজ্ঞা সম্পর্কেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অস্টিন একে ‘সার্বভৌমের আদেশ’ বলেছেন। ঐতিহাসিক মতবাদে বিশ্বাসী স্যাভিনী (Savigny), হেনরি মেইনের (Henry Maine) মতে, সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতিই আইনের রূপ লাভ করে থাকে। আইনানুগ সার্বভৌমের রচিত আইন ছাড়া প্রথা ও রীতিনীতির ভিত্তিতে গঠিত আইনও সমাজে স্বীকৃত। পাউন্ড এর মতে, সাধারণ ও নিয়মিত বিচার বিভাগীয় সংস্থা বিচারকার্য সম্পাদনে যে নিয়মগুলি স্বীকার ও প্রয়ােগ করে তাই আইন। জারস্কিনের মতে, প্রজাদের পক্ষে বাধ্যতামূলকভাবে মেনে চলবার জন্য সার্বভৌমের আদেশই আইন। হল্যান্ড (Holland) বলেন, “রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্ব দ্বারা প্রযুক্ত মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী সাধারণ নিয়মগুলি হল আইন।”
রাষ্ট্রপতি উইলসন আইন সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় করে বলেছেন, আইন হল মানুষের স্থায়ী আচার ব্যবহার ও চিন্তার সেই অংশ যা রাষ্ট্র কর্তৃক আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং যার পিছনে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সুস্পষ্ট সমর্থন রয়েছে। সহজভাবে বলা যায় যে, আইন হল মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী এমন কতকগুলি নিয়ম যা অমান্য করলে রাষ্ট্রীয় শক্তি শাস্তিবিধান করে থাকে।
প্রশ্ন ২) আইনের যে-কোনাে চারটি উৎস লেখাে
উত্তর: আইনের চারটি উৎস হল
• (ক) প্রথা
প্রথাকেই আইনের প্রাচীনতম উৎস বলে গণ্য করা যেতে পারে। সমাজজীবনে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি প্রথায় পরিণত হয়। প্রথাগুলি আইন না হলেও পরবর্তীকালে রাষ্ট্র কর্তৃত্বের দ্বারা স্বীকৃত হয়ে আইনের মর্যাদা লাভ করে।

• (খ) ধর্ম
প্রাচীন সমাজব্যবস্থায় ধর্মের প্রভাব ছিল অত্যন্ত প্রবল। ধর্মীয় অনুশাসনকে লােকে অমােঘ বলে মনে করত। আইন ও ধর্মের মধ্যে সে যুগে সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্ধারণ করা সম্ভব ছিল না। সামাজিক আচর-আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়ােজনীয় বিধিনিষেধগুলি ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। সুতরাং ধর্ম প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে আইনের বিবর্তনে সহায়তা করেছিল।
• (গ) বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত
নতন নতুন পরিবেশ, মানুষের জীবনযাত্রার পার্থক্য, জটিলতা প্রভৃতি কারণে পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থার নানা সমস্যার উদ্ভব হয়। সমাজজীবনের জটিলতার জন্য প্রথা ও ধর্ম পূর্ব উপযােগিতা হারিয়ে ফেলে, সমাজের দ্বন্দ্ব মীমাংসার দায়িত্ব এসে পড়ল রাজা বা দলপতির উপর। প্রথা ও ধর্মের অসম্পূর্ণতার ক্ষেত্রে দলপতি বা রাজা আপন বিচারবুদ্ধির প্রয়ােগ করে বিরােধের মীমাংসা করতেন। এই বিচারের রায় ভবিষ্যতে আইন বলে গণ্য হল।
• (ঘ) বিজ্ঞানসম্মত আলােচনা
কোনাে দেশের আইনব্যবস্থা সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত আলােচনা আইনের উৎস বলে গণ্য হয়। আইনের নানা অর্থ হতে পারে, সুতরাং আইনের সঠিক অর্থ ব্যাখ্যার বিশেষ প্রয়ােজন। পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যার মাধ্যমে আইনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা হয় এবং সমকালীন সমাজে তার মূল্য নির্ধারণ করা হয়। আইনজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তিগণের মতামত সরাসরি আইন বলে গণ্য হয় না । কিন্তু তাঁদের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও আলােচনা দ্বারা আইনের প্রকৃত উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়। বিচারকগণ বিচারের ক্ষেত্রে এই বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ স্বীকার করে রায় দান করেন।
প্রশ্ন ৩) আইনের বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে।
উত্তর: আইনের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে যে বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করা যায় সেগুলি হল-
(ক) আইন কতকগুলি বিধিবদ্ধ নিয়ম যা সকলে মান্য করে চলে।
(খ) আইন মানুষের বাহ্যিক আচার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে; মানুষের চিন্তা ও অনুভূতির সঙ্গে এর কোনাে সম্পর্ক নেই।
(গ) আইন নির্দিষ্ট ও সর্বজনীন; সমাজের সকল ব্যক্তির ওপর সমানভাবে প্রযােজ্য। আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান।
(ঘ) আইনের বাধ্যতামূলক রূপ রয়েছে; রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তি আইন বলবৎ করে থাকে। আইন অমান্য করলে দৈহিক শাস্তি লাভ করতে হয়।
(ঙ) আইনের প্রাধান্যমূলক ভূমিকা শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় এর প্রয়ােজনীয়তা সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করে। সভ্য সমাজ জীবনযাপনের জন্য আইন একান্ত প্রয়ােজন তা অস্বীকার করা যায় না।
প্রশ্ন ৪. আইনের অনুশাসনের অর্থ কী?
উত্তর : উনবিংশ শতাব্দীতে গ্রেট ব্রিটেনের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী ধারণার সম্প্রসারণের ফলে অধ্যাপক এ. ভি. ডাইসি আইনের অনুশাসন সম্পর্কিত তত্ত্বটি উপস্থাপন করেন। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে তার বিখ্যাত ‘An Introduction to the Law of the Constitution’ নামক গ্রন্থে এই ধারণা প্রকাশ করেন।
ডাইসির আইনের অনুশাসন তত্ত্বটি তিনটি মৌলিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত:
প্রথমত, আইনের অনুশাসন অনুযায়ী আইনের নির্দিষ্ট পদ্ধতি ব্যতীত কোনাে ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। এই নীতি অনুযায়ী দেশের মধ্যে আইন হল চরম।
দ্বিতীয়ত, আইনের অনুশাসন অনুযায়ী আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। কোনাে ব্যক্তি আইনের উর্ধ্বে নয়। সামাজিক পদমর্যাদা নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিক সাধারণ আইনের অধীন।
তৃতীয়ত, ডাইসির ব্যাখ্যানুযায়ী ব্রিটেনে নাগরিকের অধিকার সাংবিধানিক ঘােষণার ফলশ্রুতি নয়| অন্যদিকে নাগরিকের অধিকার সমষ্টি প্রথাগত আইন দ্বারা স্বীকৃত ও সংরক্ষিত।।
অধ্যাপক ডাইসির আইনের অনুশাসন সম্পর্কিত ধারণাটি নিঃসন্দেহে ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। তথাপি দেশের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত না হলে আইনের দৃষ্টিতে সাম্য বাস্তব রূপ গ্রহণ করতে পারে না।
প্রশ্ন ৫) আইনের বাধ্যবাধকতা বলতে কী বােঝ?
উত্তর : প্রতিটি রাজনৈতিক সমাজে মানুষ নির্দ্বিধায় আইন মান্য করে। প্রাচীনযুগে আইনের ভিত্তি ছিল ধর্মবােধ। মানুষ আইনকে ঐশ্বরিক বিধানরূপে গণ্য করত। বর্তমানে আইনের ভিত্তি সম্পর্কে দুই ধরনের মতবাদ প্রচলিত আছে। হবস, বেথাম, অস্টিন প্রমুখ মনে করেন যে, আইন হল সার্বভৌমের আদেশ, আইনের পশ্চাতে সার্বভৌম শক্তির সমর্থন বর্তমান। সুতরাং, সার্বভৌম শক্তির ভয়ে মানুষ আইনকে মান্য করে। কিন্তু রুশাে এবং অন্যান্য আদর্শবাদীগণ আইনকে সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রকাশ মনে করেন। সমষ্টিগত ইচ্ছার মধ্যে সর্বসাধারণের কল্যাণ নিহিত আছে। সুতরাং আইন জনগণের কল্যাণসাধন করে। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, আইনের অনুমােদন জনগণের সম্মতির উপর নির্ভরশীল। জনগণের সম্মতি বা ইচ্ছাই হল আইনের বাধ্যবাধকতার ভিত্তি।
হেনরি মেইন প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ হবস এবং রুশাের ধারণার সমন্বয়সাধন করেন। তাঁর মতে, আইনের অনুমােদন জনগণের সম্মতি এবং সার্বভৌম শক্তি উভয়ের উপর নির্ভরশীল। সার্বভৌম শক্তির ভয় আইনের বাধ্যবাধকতার আংশিক কারণরূপে গণ্য করা যায়। কিন্তু জনমত আইনকে শক্তিশালী করে। ম্যাকাইভারের মতে, জনগণের ইচ্ছা বা সম্মতি আইনের অনুমােদনের ভিত্তি হলেও আইন বাধ্যতামূলকভাবে চালিত হয়। তাঁর মতে —The root of obedience to law is not coercion but the will to obey. অধ্যাপক বার্কার মনে করেন যে, আইনের মধ্যে বৈধতা এবং নৈতিক মূল্য উভয়ের সমন্বয় ঘটানাে উচিত। মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী বৈষম্যমূলক সমাজে আইনের পশ্চাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সমর্থন থাকে।
প্রশ্ন ৬) আন্তর্জাতিক আইনকে কী প্রকৃত আইন বলা যায়?
উত্তর : আইনের সংকীর্ণ সংজ্ঞা পরিহার করে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করলে আন্তর্জাতিক আইনকে নিঃসন্দেহে আইন বলে গণ্য করা যায়। হল (Hall), লরেন্স (Lawrence), পােলক (Fredrich Pollock), ওপেনহেইম (Oppenheim) প্রমুখ আধুনিক লেখকগণ আন্তর্জাতিক আইনকে আইন বলার পক্ষপাতী। কারণ
প্রথমত, আন্তর্জাতিক আইনও রাষ্ট্রীয় আইনের ন্যায় সাধারণভাবে স্বীকৃত। যে-কোনাে রাষ্টনৈতিক সম্প্রদায়ের সদস্যগণের জীবনযাত্রা সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্যে তাদের দ্বারা স্বীকৃত এবং তাদের ওপর বলবৎযােগ্য নিয়মকানুনের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য। আন্তর্জাতিক আইন এই শর্ত যথার্থভাবে পূরণ করে।
দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক আইনও জাতীয় আইনের ন্যায় নিদিষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমে উদ্ভত হয়েছে। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, সন্ধি, চুক্তি, খ্যাতনামা আইনবিদগণের আলােচনা, বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত প্রভৃতি জাতীয় আইনের ন্যায় আন্তর্জাতিক আইনের উৎস বলে বিবেচিত।
তৃতীয়ত,পিটকবেট (Pit-Cobbet) ও অন্যান্য আইনবিদগণের মতে, আন্তর্জাতিক আইনও বাধ্যতামূলকভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্র পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মান্য করে চলে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ এবং আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন কার্যকরী করবার নির্দিষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। আইন অমান্যকারী রাষ্ট্রকে বিভিন্ন রাষ্ট ও বলিষ্ঠ আন্তর্জাতিক জনমতের বিরােধিতার সম্মুখীন হতে হয়। এ সম্ভাবনাই সকল রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আইন মান্য করে চলতে বাধ্য করে।
প্রশ্ন ৭) স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক আইন বলতে কী বােঝ?
উত্তর : প্রাচীন গ্রিসের সময় থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় প্রাকৃতিক আইন বা স্বাভাবিক আইনের দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আলােচনায় বিশেষ স্থান লাভ করেছে। উইলােবি (Willoughby) স্বাভাবিক আইনকে তিনটি অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন—প্রথমত, প্রাকৃতিক ঘটনাবলির কার্যকারণ (Cause and Effect) সম্পর্ককে স্বাভাবিক আইন বলা যায়। দ্বিতীয়ত, জীবজন্তুর স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে; যেমন, অপত্য স্নেহকে স্বাভাবিক আইন বলা যায়। আবার ধর্মীয় অনুশাসনকে স্বাভাবিক আইন বলে গণ্য করা যায়। তৃতীয়ত, সমাজের সাধারণ ন্যায়বােধ ও বিচারবুদ্ধির ওপর ভিত্তিশীল কতকগুলি সার্বজনীন নিয়মকে স্বাভাবিক আইন বলা যায়। বাস্তব জগতে যে আইন দ্বারা সমাজ শাসিত তার উর্ধ্বে আইনের স্বাভাবিক ন্যায়ভিত্তিক একটি শ্রেষ্ঠ মান আছে, তাকেও স্বাভাবিক আইন বলা হয়।
প্রাচীন গ্রিসের প্লেটো (Plato), অ্যারিস্টটল (Aristotle), সােফিস্ট (Sophist) দার্শনিকগণ এবং রােমান স্টয়িক (Stoics) পণ্ডিতগণের রচনায় স্বাভাবিক আইনের ধারণা বিশেষ স্থান লাভ করে। মধ্যযুগে অনেকে স্বাভাবিক আইনকে ঈশ্বরের আইন (Divine Law) বলে ঘােষণা করেন। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে হবস (Hobbes), লক (Locke) ও রুশাের (Rousseau) রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে প্রাকৃতিক পরিবেশে (State of Nature) মানুষ যে প্রাকৃতিক আইনের দ্বারাই পরিচালিত হতেন তা প্রচার করেন। আইনবিদ হুগাে গ্রোটিয়াস (Hugo Grotius) এবং হেনরি মেইনও (Henry Maine) স্বাভাবিক আইনের গুরুত্ব স্বীকার করেন। বিভিন্ন সময়ে স্বাভাবিক আইন নানাভাবে ব্যাখ্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্থান লাভ করেছে। স্বাভাবিক আইনের সুস্পষ্ট রূপ লক্ষ করা যায় না। স্বাভাবিক আইন বলবৎ করার কোনাে মাধ্যম নেই। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত নির্দিষ্ট আইন উপেক্ষা করে স্বাভাবিক আইনের অনুশাসনকে মান্য করা যায় না। স্বাভাবিক আইন আদর্শবাদীর কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। প্রকৃত আইন সর্বদাই কার্যকর হবে এবং রাষ্ট্র সংরক্ষণ করবে। তা ছাড়া, চিরন্তন, শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় নীতি বলে কিছু থাকতে পারে না। মানুষের ধ্যান-ধারণা স্থান-কাল ও সামাজিক অবস্থার আপেক্ষিক, সুতরাং পরিবর্তনশীল। তাই আইনও পরিবর্তনশীল।
প্রশ্ন ৮) মার্কসীয় দৃষ্টিতে স্বাধীনতা বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: মার্কসীয় দৃষ্টিতে অধিকার, স্বাধীনতা প্রভৃতি সকল ধারণাই সামাজিক কাঠামাে এবং সম্পত্তি সম্পর্কের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িত। স্বাধীনতার দ্বারাই মানুষ পূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারে। কিন্তু স্বাধীন সমাজব্যবস্থা ছাড়া প্রকৃত স্বাধীনতা সম্ভব হতে পারে না। অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রকৃত মূল্য থাকে না। প্রকৃত স্বাধীন সমাজেই রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সামর্থ্য, সামাজিক বিকাশে সুযােগ এবং ব্যক্তিত্বের মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ জীবনযাপনের সুযােগ যথার্থ স্বাধীনতা বলে গণ্য হতে পারে। প্রত্যেকের পূর্ণ বিকাশের দ্বারাই স্বাধীন সমাজ গড়ে উঠবে। জন লুইস (John Lewis) মার্কসের স্বাধীনতা সম্পর্কে ধারণা বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে, মার্কসের মতে স্বাধীনতা হল মানবজীবনের মঙ্গলকর বিষয়ের সামগ্রিকতার উপলদ্ধি এবং ব্যক্তিগত ও আত্মিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের সামর্থ্য। এর জন্য অপরিহার্যভাবে প্রয়ােজন হল মানবজীবনের ব্যক্তিগত বিষয়ের উৎপাদন পদ্ধতির ওপর যুক্তিসংগত নিয়ন্ত্রণ কর্তৃত্ব। ফ্রেডরিক এঙ্গেলস (Friedrich Engels) স্বাধীনতা সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণাটি ব্যাখ্যা করে বলেছেন : স্বাধীনতা বলতে প্রাকৃতিক নিয়ম থেকে মুক্ত হওয়া বােঝায় না; প্রাকৃতিক নিয়ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন এবং তাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কার্যকর করবার সম্ভাবনাই হল স্বাধীনতা। প্রাকৃতিক অবস্থা প্রয়ােজনীয় বিষয়গুলি সম্পর্কে জ্ঞানের ভিত্তিতে ব্যক্তিজীবন ও বহিঃপ্রকৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হল স্বাধীনতা।
প্রশ্ন ৯) আইন ও স্বাধীনতার শর্ত আলােচনা করাে।
উত্তর : স্বাধীনতা সকলের জন্য। তাই সকলের স্বাধীনতা সম্ভব করতে হলে ব্যক্তিকে কতকগুলি নিয়ন্ত্রণ মেনে চলতে হয়। বার্কারের মতে, সমাজে প্রত্যেকের স্বাধীনতার প্রয়ােজনীয়তা আবশ্যিকভাবে সকলের স্বাধীনতার প্রয়ােজনীয়তা দ্বারা সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত। নিয়ন্ত্রণ ছাড়া যথার্থ স্বাধীনতা ভােগ করা যায় না। আইনের দ্বারাই রাষ্ট্র এই নিয়ন্ত্রণ আরােপ করে। যেমন, নাগরিকের বাক-স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু এই স্বাধীনতার অপব্যবহার করে অন্য নাগরিকের দুর্নাম রটনা করলে বা সমাজের চোখে তাকে হেয় করবার চেষ্টা করলে আইন হস্তক্ষেপ করবে। বস্তুত নিয়ন্ত্রণবিহীন বা অবাধ স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। আইন না থাকলে সবল দুর্বলের ওপর, ধনী-নির্ধনের ওপর, মালিক শ্রমিকের ওপর অত্যাচার শােষণ চালাবে। অবাধ স্বাধীনতার নামে সমাজে মুষ্টিমেয় মানুষ স্বাধীনতা ভােগের সুযােগ লাভ করবে। ‘জোর যার, মুল্লুক তার’ —এই হবে সামাজিক নীতি। সমাজে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। সমাজের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীনতার সুযােগ থেকে বঞ্চিত হবে। রাষ্ট্রের কর্তব্য হল সমাজের প্রতিটি নাগরিকের সত্তা বিকাশের সুযােগসুবিধা নিশ্চিত করা, স্বাধীনতা ভােগের ব্যবস্থা করা। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে নাগরিকের কাছে আনুগত্য দাবি করতে পারে না। নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্র নাগরিকের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব পালন করে থাকে।
     সুতরাং, স্বাধীনতা ও আইন পরস্পরবিরােধী নয়, একে অন্যের পরিপূরক। স্বাধীনতা বলতে নিয়ন্ত্রণবিহীনতা বােঝায় না, অযৌক্তিক নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে যুক্তিসংগত নিয়ন্ত্রণ আরােপ বােঝায়। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে যুক্তিসংগত নিয়ন্ত্রণ আরােপ করে ব্যক্তি স্বাধীনতা সম্ভব করে। তাই আইনই স্বাধীনতার শর্ত (“Law is the condition of liberty”)
প্রশ্ন ১০) সাম্যের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি বর্ণনা করাে।
উত্তর: স্বাধীনতার মতাে সাম্যের ধারণাও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন সংগ্রামে সাম্যের আদর্শকেও মূল্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাম্যের প্রকৃতি ও সুস্পষ্ট অর্থ সম্বন্ধে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গভীর মতপার্থক্যের সুযােগ ঘটেছে। সাম্য বলতে সকল মানুষ সমান বােঝায়, কিন্তু কোন অর্থে মানুষের সঙ্গে মানুষের সমানাবস্থা থাকতে পারে? সাম্যের ধারণা চূড়ান্ত বা স্বতঃসিদ্ধ নয়, এটা আপেক্ষিক। মানুষের সঙ্গে মানুষের দৈহিক ও মানসিক গঠন, নৈতিক যােগ্যতার পার্থক্য রয়েছে। স্বাভাবিক বা প্রকৃতিগতভাবে মানুষে মানুষে এই পার্থক্য অস্বীকার করা যায় না। সুতরাং সাম্য বলতে ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে সকলের অভিন্নতা বােঝাতে পারে না। দৈহিক ও বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে মানুষের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য স্বীকার করতেই হয়। অ্যারিস্টটল বলেছেন যে “অনেক রাষ্ট্রে বিদ্রোহ বা বিপ্লবের পিছনে আছে অসাম্য (Inequality)। সমাজ মানুষের প্রতি সাম্যের দৃষ্টিতে দেখা এবং অসমান মানুষের প্রতি অসাম্যমূলক ব্যবহার। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী প্রচলিত সামাজিক চেতনার মানদণ্ডে স্বীকৃত অসাম্যমূলক ব্যবস্থার প্রতিবিধান বােঝায়।” অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, মানুষের অভাব ও যােগ্যতার ক্ষেত্রে যতদিন পার্থক্য থাকবে, তত দিন চূড়ান্তভাবে অভিন্ন ব্যবহার সমাজে থাকতে পারে না। একজন দার্শনিক ও একজন শ্রমিকের প্রয়ােজন ও যােগ্যতা সমপর্যায়ের হতে পারে না। একজন বিজ্ঞানী ও একজন সাধারণ শ্রমিকের সমান মর্যাদা ও স্বীকৃতি দান করা হলে সমাজের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। মানুষের যােগ্যতা ও কর্মশক্তির পার্থক্য যেহেতু রয়েছে, সেহেতু সকলে রাষ্ট্রের নিকট সমান ব্যবহার দাবি করতে পারে না। তাহলে সাম্য বলতে প্রকৃত অর্থে কি বােঝায়? এর সর্বসম্মত উত্তর এখনও দেওয়া সম্ভব হয়নি। অধ্যাপক ল্যাস্কির
মতে, সাম্য বলতে প্রাথমিকভাবে বােঝায় “বিশেষ সুযােগসুবিধার অনুপস্থিতি।”
প্রশ্ন ১১) সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলােচনা করাে।
উত্তর : বর্তমানে বহু দার্শনিক সাম্য ও স্বাধীনতার পরস্পরবিরােধী রূপ স্বীকার করেন না। মেইটল্যান্ড (Maitland), গডউইন (Godwin), রুশাে (Rousseau), টনি (R.H. Tawney), বার্কার(Barker), ল্যাস্কি (Laski) এবং মার্কসবাদীগণ (Marxists) সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরের পরিপূরক বলে স্বীকার করেন। টনি বলেছেন, “সাম্য স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়, স্বাধীনতার পক্ষে একান্ত প্রয়ােজন।” স্বাধীনতার ধারণাকে কার্যকর করতে সাম্যের প্রয়ােজন অপরিহার্য। সমাজজীবনে পৌর বা রাজনৈতিক স্বাধীনতা তখনই সার্থক হতে পারে যখন আইনের দৃষ্টিতে সমানাধিকার স্বীকৃত হয় এবং প্রত্যেক নাগরিক শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সমান সুযােগ লাভ করে। অর্থনৈতিক প্রয়ােজন পূরণের পর উপযুক্ত অবসর মিললেই স্বাধীন চিন্তার বিকাশ সম্ভব হতে পারে। বিশেষ সুযােগসুবিধার অস্তিত্ব স্বাধীনতার পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে না। ল্যাস্কির মতে, স্বাধীনতা হল এমন এক সামাজিক পরিবেশ যার মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি পূর্ণভাবে বিকশিত করতে পারে। এই পরিবেশ একমাত্র সকলের সমান অধিকারের ভিত্তিতে সৃষ্টি হতে পারে। স্বাধীনতা বলতে যদি মানবতার নিরবচ্ছিন্ন সম্প্রসারণ বােঝায়, তাহলে সাম্যভিত্তিক সমাজ ছাড়া অন্যত্র সেই স্বাধীনতা সম্ভব নয়। রুশাের ভাষায় সাম্য ছাড়া স্বাধীনতার অস্তিত্বই সম্ভব নয়। এই অভিমতের যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না। স্বাধীনতা সম্ভব করবার জন্যই রাষ্ট্রকে এমন পরিবেশ সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করতে হয় যেখানে বিশেষ সুযােগসুবিধার কোনাে অস্তিত্ব থাকবে না। শ্রেণিবৈষম্য বা সম্পদ বৈষম্য স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে।
প্রশ্ন ১২) সাম্য ব্যতীত স্বাধীনতার অস্তিত্ব কি সম্ভব?
উত্তর : সাম্য ও স্বাধীনতা একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে যুক্ত। সাম্য ছাড়া স্বাধীনতা সম্ভব কিনা এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্যের দাবি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে, তখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী উদারনৈতিক দার্শনিকগণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্যকে স্বাধীনতার পরিপন্থী মনে করতেন। লর্ড অ্যাক্টন, টকভিল, লেকি, বেজহট প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরবিরােধী বলে অভিহিত করেন। লর্ড অ্যাক্টনের মতে, সাম্যের জন্যে আবেগ স্বাধীনতার আশাকে মিথ্যায় পর্যবসিত করে। কিন্তু সাম্য ও স্বাধীনতার পরস্পর বিরােধিতার দৃষ্টিভঙ্গি অনেক দার্শনিক স্বীকার করেন না। মেটল্যান্ড, গডউইন, রুশাে, বার্কার, ল্যাস্কি এবং মার্কসবাদীগণ সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরের পরিপূরক বলে স্বীকার করেন। টনি বলেছেন, সাম্য স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়, স্বাধীনতার পক্ষে একান্ত প্রয়ােজন। অধ্যাপক ল্যাস্কি মনে করেন যে, সমাজের মধ্যে বিশেষ সুযােগসুবিধার অস্তিত্ব থাকলে জনগণের কোনাে স্বাধীনতার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এই অভিমতের যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না। তাই সাম্য কখনও স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়। একমাত্র সাম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ধনবৈষম্যমূলক সমাজে স্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য উপলদ্ধি সম্ভব নয়।
প্রশ্ন ১৩) ন্যায়বিচারের সংজ্ঞা দাও। ন্যায়বিচারের প্রকৃতি আলােচনা করাে।
উত্তর : গ্রিস রাষ্ট্রচিন্তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পদ। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রচিন্তা, গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, ন্যায়বিচার ইত্যাদি সম্পর্কে প্লেটো ও অ্যারিস্টটল যে-সমস্ত কথা বলে গিয়েছেন তা আজও সমাজ-বিজ্ঞানের এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের কাছে গভীর চিন্তার বিষয়। ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে প্লেটো ন্যায়বিচারের পক্ষে জোর সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তি ও ন্যায়বিচার সমাজের ভিত। আইন যখন রচনা করা হবে তখন আইন প্রণেতারা লক্ষ রাখবেন তা যেন ন্যায়বিচারের ধারণাকে লঙ্ঘন না করে।
     প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের কতকগুলি অপরিহার্য গুণাবলির উল্লেখ করেছেন। যেমন—সহনশীলতা, সাহস, প্রজ্ঞা ও ন্যায়বিচার। আদর্শ রাষ্ট্রের চতুর্থ গুণ হল ন্যায়বিচার। এটি কোনাে বিশেষ শ্রেণির এককগুণ নয়। এর যদি সম্পূর্ণ বিকাশ না ঘটে তাহলে রাষ্ট্র কখনােই আদর্শ রাষ্ট্র বলে বিবেচিত হতে পারে না। প্রতিটি ব্যক্তির যা প্রাপ্য তাকে তা দেবার নাম ন্যায়বিচার। প্রত্যেক ব্যক্তির কতকগুলি সহজাত গুণাবলি আছে। এই গুণাবলির সাহায্যেই ব্যক্তি কোনাে কাজ করার শক্তি বা সামর্থ্য অর্জন করে থাকে। ব্যক্তির কাজ এমন হওয়া দরকার যার ফলে রাষ্ট্রের উন্নতি বৃদ্ধি পায়। এই কাজ করার জন্য ব্যক্তি অবশ্যই কিছু প্রাপ্য দাবি করতে পারে। এই প্রাপ্য থেকে যদি তাকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে তার প্রতি অবিচার করা হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হবে।
     প্রতিটি ব্যক্তি বা শ্রেণি যদি নিজ নিজ কাজ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে করে তবেই ন্যায়বিচার বিকশিত হবার সুযােগ পাবে। ড. অমল কুমার মুখােপাধ্যায় তাঁর Western Political Thought গ্রন্থে বলেছেন যে, সমাজের তিনটি শ্রেণি যদি তাদের কাজ ঠিকঠাক করে তবে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এক শ্রেণি অন্য শ্রেণির কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। ন্যায়বিচার একটি নির্দেশিকা যা সমাজের অন্যায়, ত্রুটি দূর করে। প্লেটোর ধারণা প্রত্যেকে যদি নির্দিষ্ট কাজ করে এবং তার প্রাপ্য পায় তবে ন্যায়বিচার রক্ষিত হবে। সমাজ বিশৃঙ্খলার হাত থেকে রেহাই পাবে। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে। সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হবে। আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য সামাজিক নায়বিচার অপরিহার্য। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে সাম্য ও ন্যায় ওতপ্রােতভাবে জড়িত।
প্রশ্ন ১৪) ন্যায়বিচারের বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী?
উত্তর : প্লেটোর ন্যায় বিচারতত্ত্ব বিশ্লেষণ করে আমরা ন্যায়বিচারের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। যেমন—
(ক) ন্যায়বিচার সমন্বয়সাধনকারী, সম্প্রীতিতে ভরা একটি বন্ধন। এই বন্ধন সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তিকে এক সূত্রে আবদ্ধ করে।
(খ) ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিগুলিও নিজেদের মধ্যে সম্পর্কযুক্ত হয়ে পড়ে।
(গ) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে অথবা রাষ্ট্র যদি ন্যায়বিচারের রক্ষক হয় তবে সমাজে কোনাে রকম সংঘর্ষ দেখা দিতে পারে না।
(ঘ) আদর্শ রাষ্ট্রের লক্ষ্য হল সবরকম শ্রেণি সংঘর্ষকে উৎপাটিত করা। এটি সম্ভব, যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
(ঙ) প্লেটোর মতে, ন্যায়বিচারের ভিত্তি হল যুক্তি ও প্রচলিত রীতি। সমাজে যদি কেউ অন্যায় কাজ করে অথবা অন্যের প্রতি অবিচার করে কিংবা অন্যেরা তাকে অনুসরণ করে তাহলে ন্যায়বিচারের অবলুপ্তি ঘটবে।
(চ) ন্যায়বিচারের ধারণা সামাজিক মানুষকে যুক্তিবাদী করে তোেল। মানুষের এই যুক্তিবাদী মনােভাব ন্যায়বিচারের সহায়ক হয়। মানুষ নীতি বহির্ভূত কোনাে কাজ করতে চাইবে না।
(ছ) ন্যায়বিচার সমাজে প্রীতি, ভালােবাসা-সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরি করে। এটাই তাে মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
(জ) মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। মানুষ নিজ প্রয়ােজনে সমাজে বাস করে। পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই পরস্পর নির্ভরশীলতাই হল ন্যায়বিচারের ভিত্তি।
প্রশ্ন ১৫) মার্কসবাদীদের মতে পুঁজিবাদী সমাজে স্বাধীনতা সম্ভব নয় কেন?
উত্তর : মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী পুঁজিবাদ হল একটি শ্রেণিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা। পুঁজিবাদী সমাজে সর্বপ্রকার অসাম্য ও বৈষম্যকে প্রশ্রয় দিয়ে সম্পত্তিবান শ্রেণির স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এইরূপ সমাজে উৎপাদনের উপকরণের উপর সংখ্যালঘু শ্রেণির মালিকানা থাকার ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জীবনে সর্বপ্রকার সুযােগ থেকে বঞ্চিত থাকে। মার্কসবাদীরা মনে করেন যে, অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকলে সমাজে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্র শুধুমাত্র বণিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। এইরূপ সমাজে রাষ্ট্রীয় আইন সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার রক্ষক নয়। তাই মার্কসীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আপথেকারের মতে, পুঁজিবাদী সমাজে স্বাধীনতার অর্থ হল বুর্জোয়া শ্রেণির স্বাধীনতা।
Comment

Class XI Political Science

Class XII Political Science

Class 12 Bangla Books Question& Answers