আইন, স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায় বিচার
প্রশ্ন ১। আইনের সংজ্ঞা দাও।
উত্তর: আইন হল রাষ্ট্রের দ্বারা সৃষ্ট, স্বীকৃত ও প্রযােজ্য সেই সমস্ত নিয়মকানুন যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ব্যক্তি, সংঘ ও প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইন কথাটি সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এই দিক দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইন বলতে সাধারণভাবে সেই সমস্ত নিয়মকানুনকেই বােঝায় যা মানুষের বাহ্যিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এককথায় রাষ্ট্রের নিয়মকানুনই হল আইন।
প্রশ্ন ২। আইনের উৎসসমূহ কী?
উত্তর: আইনের উৎসগুলি হল—প্রথা, ধর্ম, বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত, পণ্ডিত ব্যক্তিগণের আলােচনা, ন্যায়বিচার এবং আইনসভা বা আনুষ্ঠানিক আইন প্রণয়ন।
প্রশ্ন ৩। আইনের বৈশিষ্ট্য কী?
উত্তর: (i) আইন নিয়মের সমষ্টি, এর লক্ষ্য বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা, (ii) আইন মানুষকে অধিকার দেয়, (iii) আইন সার্বজনীন, (iv) আইন সার্বভৌম শক্তির দ্বারা সৃষ্ট, (v) আইন ভঙ্গ করলে শাস্তি পেতে হয়।
প্রশ্ন ৪। আইনের মার্কসীয় সংজ্ঞা কী?
উত্তর: মার্কস ও মার্কসবাদীরা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে আইনের সংজ্ঞা দিয়েছেন। মার্কসের মতে, আইন বলতে বােঝায় রাষ্ট্রের নিয়মকানুনের সমষ্টি যা শাসক শ্রেণির স্বার্থকে রক্ষা করে। যার দ্বারা বড়ােলােক শ্রেণি উপকৃত হয়।
প্রশ্ন ৫। অস্টিন প্রদত্ত আইনের সংজ্ঞা দাও।
উত্তর: অস্টিনের মতে, আইন সার্বভৌমের আদেশ। এই আইনের পশ্চাতে সবচেয়ে বড়াে সমর্থন হল রাষ্ট্র কর্তৃত্ব। আইন মান্য না করলে আইনভঙ্গকারীকে শাস্তি পেতেই হবে।
প্রশ্ন ৬। আইনের অনুশাসন কাকে বলে?
উত্তর: আইনের অনুশাসন ব্যক্তিস্বাধীনতাকে রক্ষা করে। এর অর্থ হল, ‘আইনের চোখে সবাই সমান। আইনের অনুশাসনের রূপকার অধ্যাপক ডাইসির মতে, কোনাে অবস্থাতেই আইনের প্রয়ােগে জাতপাত, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গভেদে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে তারতম্য করা যাবে না। সকলের ক্ষেত্রে আইন একইভাবে প্রযােজ্য হবে।
প্রশ্ন ৭। অর্পিত আইন বলতে কী বােঝ?
উত্তর: আইনসভা মূলত আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু যখন আইনসভা আইনের মূল লক্ষ করে আইনটিকে সম্পূর্ণ করবার দায়িত্ব শাসন বিভাগের ওপর অর্পণ করে এবং শাসন বিভাগ এই ক্ষমতাবলে যে আইন প্রণয়ন করে তাকেই অর্পিত আইন (Delegated Legislation) বলে। একে আবার অধস্তন আইন প্রণয়ন (Subordinate Legislation) বলা হয়।
প্রশ্ন ৮। আইনকে কোন্ অর্থে সাধারণ ইচ্ছার প্রকাশ’ বলা হয়?
উত্তর: সাধারণ ইচ্ছা সমাজের সকল জনগণের কল্যাণকামী ইচ্ছার (Real Will) সমষ্টি। রুশাের মতে সাধারণ ইচ্ছাই সমাজে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিতে প্রণীত আইনকে সেই কারণেই সাধারণ ইচ্ছার প্রকাশ’ বলে রুশাে অভিহিত করেছেন। সমাজে কোনাে ব্যক্তি আইন অমান্য করলে মনে করতে হবে যে সেই ব্যক্তি অপ্রকৃত ইচ্ছার (Unreal Will) দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এই অবস্থায় তাকে সাধারণ ইচ্ছার অনুগামী হতে অর্থাৎ আইন মান্য করে চলতে বাধ্য করা হবে।
প্রশ্ন ৯। আন্তর্জাতিক আইন কাকে বলে?
উত্তর: লরেন্সের (S. T. Lawrence) মতে, যে-সকল নিয়মকানুন দ্বারা সভ্য রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারিত এবং পারস্পরিক আচার-ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হয়, তাকেই আন্তর্জাতিক আইন বলে। অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক আইনকে আইন বলে স্বীকার করতে চান না।
প্রশ্ন ১০। আন্তর্জাতিক আইনের উৎস কী?
উত্তর: প্রথা ও চুক্তিকেই সাধারণভাবে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস বলে গণ্য করা হয়। আন্তর্জাতিক আদালতের বিধির ৩৮ ধারায় (Article 38, Statute of International Court of Justice) আন্তর্জাতিক আইনের যে উৎসগুলির কথা বলা হয়েছে সেগুলি হল—(ক) সাধারণ বা বিশেষ আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বারা সৃষ্ট নিয়মাবলি যা বিবদমান রাষ্ট্রগুলি স্বীকার করে নেয়, (খ) আইনের মতাে বাধ্যতামূলকভাবে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক প্রথাসমূহ, (গ) সভ্য রাষ্ট্রগুলির দ্বারা স্বীকৃত আইনের সাধারণ নিয়মাবলি এবং (ঘ) বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত ও খ্যাতনামা আইনবিদগণের প্রকাশিত রচনাসমূহ।
প্রশ্ন ১১। আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকৃত আইনের মর্যাদা দেওয়া যায় না কেন?
উত্তর: আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকৃত আইনের মর্যাদা দেওয়া যায় না। কারণ—(ক) আন্তর্জাতিক আইনগুলি সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট নয়। (খ) আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের শাস্তি দেবার ক্ষমতা নেই। (গ) প্রতিটি রাষ্ট্র সার্বভৌম বলে তাদের উপর বাধ্যতামূলকভাবে আইনকে চাপানাে যায় না। (ঘ) আন্তর্জাতিক আইন তৈরি করার জন্য কোনাে বিশ্ব আইনসভা নেই।
প্রশ্ন ১২। আইন ও নৈতিক বিধির মধ্যে মূল পার্থক্য কী?
উত্তর: প্রথমত, আইন মানুষের বাহ্যিক আচার-ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু নৈতিক বিধি বাহ্যিক আচার-আচরণ, চিন্তা সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। দ্বিতীয়ত, আইন রচিত হয়। কিন্তু নৈতিক বিধি নিয়ম মেনে রচনা করা হয় না। তৃতীয়ত, আইন সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট, কিন্তু নৈতিক বিধি অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট। চতুর্থত, আইনের পিছনে সার্বভৌম শক্তির সমর্থন থাকে, আইন ভঙ্গ করলে দৈহিক শাস্তি ভােগ করতে হয়। নৈতিক বিধি ভঙ্গের জন্য কোনাে দৈহিক শাস্তির সুযােগ থাকে না। নীতিহীন কাজের শাস্তি হল সামাজিক নিন্দা ও বিবেকের দংশন।
প্রশ্ন ১৩। স্বাধীনতা বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: স্বাধীনতা নেতিবাচক অর্থে নিয়ন্ত্রণবিহীনতা বােঝায়। কিন্তু ইতিবাচক অর্থে স্বাধীনতা বলতে আত্মবিকাশের সুযােগ বােঝায়। অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কির মতে, স্বাধীনতা বলতে সেই পরিবেশের সযত্ন সংরক্ষণ বােঝায়, যেখানে মানুষ জীবনের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ খুঁজে পায়।
প্রশ্ন ১৪। ব্যক্তিস্বাধীনতা বা পৌরস্বাধীনতা কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর: যে-সকল অধিকার ভােগ দ্বারা মানুষ তার ব্যক্তিসত্তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সাধন করতে পারে, তাকেই ব্যক্তিস্বাধীনতা বা পৌরস্বাধীনতা বলে। সম্পত্তির অধিকার, ধর্মের অধিকার, বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার উল্লেখযােগ্য উদাহরণ।
প্রশ্ন ১৫। স্বাধীনতা সম্পর্কে বুর্জোয়া ধারণা কী?
উত্তর: স্বাধীনতা সম্পর্কে বুর্জোয়া ধারণা সম্পূর্ণ নেতিবাচক। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটলে স্বাধীনতা ভােগ করা সম্ভব বলে এই তত্ত্বের সমর্থকরা বিশ্বাস করে। বুর্জোয়া ধারণায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা অপেক্ষা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অধিক গুরুত্ব পায়। বুর্জোয়া তত্ত্ব ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে পবিত্র বলে গণ্য করে। আর্থিক অসাম্য, স্বতঃস্ফূর্ততা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ এবং মুষ্টিমেয় বাছাই লােকের শাসন বুর্জোয়া স্বাধীনতার বৈশিষ্ট্য।
প্রশ্ন ১৬। স্বাধীনতা সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণা কী?
উত্তর: মার্কসীয় দৃষ্টিতে স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণবিহীনতা নয়। ইতিবাচক অর্থে সকল প্রকার শােষণের অবসানে মানুষের সামাজিক মুক্তির পথ প্রশস্ত করার কথা বলা হয়। স্বাধীনতা হল মানুষের পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযােগ যা শােষণভিত্তিক ব্যবস্থার অবসান ঘটলে সম্ভব হতে পারে। সুসংহত দৃষ্টিতে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে গ্রহণ করা হয়।
প্রশ্ন ১৭। রাজনৈতিক স্বাধীনতা কাকে বলে?
উত্তর: জনগণ যাতে দেশের শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করার সুযােগসুবিধা লাভ করে, সেই ব্যবস্থা থাকাই হল রাজনৈতিক স্বাধীনতা। যথা—ভােটদানের অধিকার, সরকারের গঠনমূলক সমালােচনার অধিকার প্রভৃতি।
প্রশ্ন ১৮। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থে দারিদ্র্য বা ক্ষুধার হাত থেকে মুক্তি বােঝায়। দৈনন্দিনের অন্নসংস্থানে যুক্তিসংগত অর্থ খুঁজে পাওয়ার সুযােগ ও নিরাপত্তা হল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। অধিকাংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন যে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভিন্ন সামাজিক বা রাজনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন। কর্মের অধিকার, অবকাশের অধিকার, বেকারবার্ধক্য ভাতা পাওয়ার অধিকার, অক্ষমতার রাষ্ট্র দ্বারা প্রতিপালিত হওয়ার অধিকার প্রভৃতি এর উদাহরণ।
প্রশ্ন ১৯। জাতীয় স্বাধীনতা বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: জাতীয় স্বাধীনতা বলতে বিদেশি শক্তির নিয়ন্ত্রণমুক্ততা বােঝায়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১৫ আগস্ট ইংরেজ শাসনমুক্ত হয়ে ভারত জাতীয় স্বাধীনতা লাভ করে।
প্রশ্ন ২০। আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক কী?
উত্তর: আপাতদৃষ্টিতে আইন ও স্বাধীনতা পরস্পরবিরােধী মনে হয়। মিল, স্পেন্সার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন যে, আইন রাষ্ট্র কর্তৃক ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুগ্ন বা খর্ব করে। কিন্তু একথা সত্য বলে গ্রহণ করা যায় না। স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত না হলে সবলের অত্যাচারে দুর্বলের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়। অধ্যাপক বাৰ্কার বলেন যে, প্রত্যেকের স্বাধীনতার প্রয়ােজনীয়তা সকলের স্বাধীনতার প্রয়ােজনীয়তার দ্বারা সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত। স্বাধীনতা সমাজের সকলের। সুতরাং, সকলের স্বাধীনতা সম্ভব করতে প্রত্যেকের অনিয়ন্ত্রণ স্বীকার করা যায় না। সুতরাং, রাষ্ট্রের আইন দ্বারা অনুমােদিত স্বাধীনতাই প্রকৃত স্বাধীনতা। আইনই স্বাধীনতার শর্ত বলা যায়।
প্রশ্ন ২১। সাম্য কাকে বলে?
উত্তর: সাধারণভাবে সাম্য বলতে সকলে সমান বােঝায়। বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায় যে, শারীরিক ও মানসিক গঠনের দিক থেকে মানুষে মানুষে পার্থক্য আছে। সুতরাং, সাম্য বলতে ব্যবহারের অভিন্নতা বোঝায়। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে সাম্য বলতে সুযােগের সমতা বােঝায়। মার্কসীয় দৃষ্টিতে সাম্য বলতে সমাজের শ্রেণিবিভাগ বিলােপের কথা বলা হয়। সকলের সমান সুযােগ এবং বিশেষ সুযােগসুবিধার অনুপস্থিতি—এই দুটিই হল সাম্যের মূলকথা।
প্রশ্ন ২২। সাম্য কয় প্রকার ও কী কী?
উত্তর: সাধারণ দৃষ্টিতে বিচার করলে সাম্যকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। এগুলি হল—(ক) সামাজিক সাম্য, (খ) আইনগত সাম্য এবং (গ) স্বাভাবিক সাম্য। এই আইনগত সাম্যের আবার তিনটি রূপ আছে-(i) অর্থনৈতিক সাম্য, (ii) রাজনৈতিক সাম্য এবং (iii) ব্যক্তিগত সাম্য।
প্রশ্ন ২৩। ল্যাস্কির মতে সাম্যের দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করাে।
উত্তর: (ক) কোনাে বিশেষ সুযােগসুবিধার অনুপস্থিতি এবং (খ) সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযােগসুবিধা।
প্রশ্ন ২৪। মার্কসবাদী দৃষ্টিতে সাম্য বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারবিশ্লেষণ করে একথা বলা যায় যে, প্রকৃত অর্থে সমাজে। সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে সামাজিক বৈষম্যের মূল কারণগুলিকে উৎপাটিত করতে হবে এবং সেইসঙ্গে এমন এক পরিবেশের সংরক্ষণ সুনিশ্চিত করতে হবে যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি তার যােগ্যতা অনুসারে ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের সুযােগ পায়। মার্কসবাদীদের মতে, বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় প্রকৃত সাম্য কখনােই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
প্রশ্ন ২৫। পুঁজিবাদী সমাজে সাম্যের প্রকৃতি পর্যালােচনা করাে।
উত্তর: সামন্তসমাজের গর্ভ থেকে উদ্ভূত পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিপতি শ্রেণি সাম্যের দাবিতে সােচ্চার হলেও পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় যে সাম্যের আদর্শের কথা ঘােষণা করা হয় তার প্রকৃতি ছিল মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক। কিন্তু এই সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সাম্যের অনুপস্থিতিতে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য অর্থহীন হয়ে যায়। যদিও পুঁজিবাদী সমাজই হল প্রথম সমাজ যেখানে আইনের চোখে সাম্যের দাবি প্রথম উখিত হয় এবং সাম্যের অধিকারের আইনগত স্বীকৃতির জন্য সংগ্রাম শুরু হয়।
প্রশ্ন ২৬। সামাজিক সাম্য কাকে বলে?
উত্তর: জাতি, ধর্ম, বংশ, বর্ণ বা অর্থ কৌলিন্যের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে প্রভেদ করা হলে সেখানে সামাজিক সাম্য থাকে না। কিন্তু যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বংশ প্রভৃতির ভিত্তিতে মানুষের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য করা হয় না, সেখানে সামাজিক সাম্য থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতকায় ও কৃয়কায় মানুষের মধ্যে সামাজিক দিক থেকে বৈষম্য করা হয়, তাই সেখানে সামাজিক সাম্য থাকে না।
প্রশ্ন ২৭। রাজনৈতিক সাম্য বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমান অধিকার ভােগের সুযােগকেই রাজনৈতিক সাম্য বলে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রীপুরুষ নির্বিশেষে, সুস্থ মস্তিষ্ক প্রাপ্তবয়স্কের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সমান সুযােগ থাকলে রাজনৈতিক সাম্য বর্তমান বলা যায়। নির্বাচন করা ও নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে সমান সুযােগকে রাজনৈতিক সাম্য বলা যায়।
প্রশ্ন ২৮। স্বাধীনতা ও সাম্যের সম্পর্ক কী?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যাক্টন, টকভিল প্রমুখ মনে করেন যে, সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরােধী। সাম্যের জন্যে আবেগ স্বাধীনতাকে নির্মূল করে। বাস্তবে সাম্য স্বাধীনতার বিরােধী নয়, পরিপূরক। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে সমাজে বিশেষ সুযােগসুবিধার অস্তিত্ব থাকলে ব্যক্তির স্বাধীনতা সম্ভব হয় না। আর. এইচ. টনি বলেন, স্বাধীনতা বলতে যদি মানবাত্মার নিরবচ্ছিন্ন প্রসার বােঝায়, তাহলে একমাত্র সাম্যভিত্তিক সমাজেই সেই স্বাধীনতা সম্ভব। সুতরাং সাম্য কখনই স্বাধীনতার পরিপন্থী হতে পারে না।
প্রশ্ন ২৯। স্বাভাবিক সাম্য বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: স্বাভাবিক সাম্য বলতে বােঝায় যে, মানুষ জন্মগত ভাবে সমান সুযােগসুবিধার অধিকারী। আমেরিকার স্বাধীনতা ঘােষণায় স্বাভাবিক সাম্যের তত্ত্ব স্বীকৃত হয়। কিন্তু জন্মগতভাবে দেহ মনে সব মানুষ সমান হতে পারে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মানুষের স্বাভাবিক বৈষম্যকে স্বীকার করেই সাম্য তত্ত্বে প্রচার করা হয়। বর্তমানে স্বাভাবিক সাম্য তত্ত্ব অবাস্তব বলে মনে করা হয়।
প্রশ্ন ৩০। সাম্যের মূলকথা কী?
উত্তর: বাস্তবক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে মানুষের দৈহিক ও মানসিক পার্থক্য থাকে। তাই সাম্য বললে ব্যবহারের অভিন্নতা বােঝায় না। অধ্যাপক ল্যাস্কির মত অনুসারে সাম্য বলতে মূলত দুটি বিষয় বােঝায়—(ক) বিশেষ সুযােগসুবিধার অনুপস্থিতি ও (খ) সকলের জন্য উপযুক্ত সুযােগসুবিধার ব্যবস্থা করা।
প্রশ্ন ৩১। সকল আইনই কি স্বাধীনতার সহায়ক?
উত্তর: সমাজবদ্ধ মানুষ কখনও অবাধ স্বাধীনতা ভােগ করতে পারে না। রাষ্ট্রীয় আইন বা নিয়ন্ত্রণের দ্বারা সকলের স্বাধীনতা ভােগ সম্ভব হয়। কিন্তু আইন সৃষ্টি হয় সরকারের দ্বারা। সরকার মুষ্টিমেয় ব্যক্তি নিয়ে গঠিত। সুতরাং, সরকারের আইন সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতার সহায়ক হতে পারেনা। ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী আইন মান্য করার অর্থ ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা। তাই আইন সর্বক্ষেত্রে স্বাধীনতার সহায়ক হয় না।
প্রশ্ন ৩২। ন্যায়ের ধারণাকে কটি দিক দিয়ে বিচার করা যায় ও কী কী?
উত্তর: ন্যায়ের ধারণাকে ৪টি দিক দিয়ে বিচার করা যায়। যেমন—(ক) আইনগত, (খ) রাজনৈতিক, (গ) সামাজিক ও (ঘ) অর্থনৈতিক।
প্রশ্ন ৩৩। ন্যায়ের সংজ্ঞা নির্ধারণে অসুবিধা কী?
উত্তর: ন্যায়ের ধারণা কোনাে স্বতন্ত্র ধারণা নয়, সমাজব্যবস্থার আচার-আচরণ ও মূল্যবােধের সঙ্গে ন্যায়ের ধারণা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
উত্তর: আইন হল রাষ্ট্রের দ্বারা সৃষ্ট, স্বীকৃত ও প্রযােজ্য সেই সমস্ত নিয়মকানুন যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ব্যক্তি, সংঘ ও প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইন কথাটি সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এই দিক দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইন বলতে সাধারণভাবে সেই সমস্ত নিয়মকানুনকেই বােঝায় যা মানুষের বাহ্যিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এককথায় রাষ্ট্রের নিয়মকানুনই হল আইন।
প্রশ্ন ২। আইনের উৎসসমূহ কী?
উত্তর: আইনের উৎসগুলি হল—প্রথা, ধর্ম, বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত, পণ্ডিত ব্যক্তিগণের আলােচনা, ন্যায়বিচার এবং আইনসভা বা আনুষ্ঠানিক আইন প্রণয়ন।
প্রশ্ন ৩। আইনের বৈশিষ্ট্য কী?
উত্তর: (i) আইন নিয়মের সমষ্টি, এর লক্ষ্য বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা, (ii) আইন মানুষকে অধিকার দেয়, (iii) আইন সার্বজনীন, (iv) আইন সার্বভৌম শক্তির দ্বারা সৃষ্ট, (v) আইন ভঙ্গ করলে শাস্তি পেতে হয়।
প্রশ্ন ৪। আইনের মার্কসীয় সংজ্ঞা কী?
উত্তর: মার্কস ও মার্কসবাদীরা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে আইনের সংজ্ঞা দিয়েছেন। মার্কসের মতে, আইন বলতে বােঝায় রাষ্ট্রের নিয়মকানুনের সমষ্টি যা শাসক শ্রেণির স্বার্থকে রক্ষা করে। যার দ্বারা বড়ােলােক শ্রেণি উপকৃত হয়।
প্রশ্ন ৫। অস্টিন প্রদত্ত আইনের সংজ্ঞা দাও।
উত্তর: অস্টিনের মতে, আইন সার্বভৌমের আদেশ। এই আইনের পশ্চাতে সবচেয়ে বড়াে সমর্থন হল রাষ্ট্র কর্তৃত্ব। আইন মান্য না করলে আইনভঙ্গকারীকে শাস্তি পেতেই হবে।
প্রশ্ন ৬। আইনের অনুশাসন কাকে বলে?
উত্তর: আইনের অনুশাসন ব্যক্তিস্বাধীনতাকে রক্ষা করে। এর অর্থ হল, ‘আইনের চোখে সবাই সমান। আইনের অনুশাসনের রূপকার অধ্যাপক ডাইসির মতে, কোনাে অবস্থাতেই আইনের প্রয়ােগে জাতপাত, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গভেদে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে তারতম্য করা যাবে না। সকলের ক্ষেত্রে আইন একইভাবে প্রযােজ্য হবে।
প্রশ্ন ৭। অর্পিত আইন বলতে কী বােঝ?
উত্তর: আইনসভা মূলত আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু যখন আইনসভা আইনের মূল লক্ষ করে আইনটিকে সম্পূর্ণ করবার দায়িত্ব শাসন বিভাগের ওপর অর্পণ করে এবং শাসন বিভাগ এই ক্ষমতাবলে যে আইন প্রণয়ন করে তাকেই অর্পিত আইন (Delegated Legislation) বলে। একে আবার অধস্তন আইন প্রণয়ন (Subordinate Legislation) বলা হয়।
প্রশ্ন ৮। আইনকে কোন্ অর্থে সাধারণ ইচ্ছার প্রকাশ’ বলা হয়?
উত্তর: সাধারণ ইচ্ছা সমাজের সকল জনগণের কল্যাণকামী ইচ্ছার (Real Will) সমষ্টি। রুশাের মতে সাধারণ ইচ্ছাই সমাজে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিতে প্রণীত আইনকে সেই কারণেই সাধারণ ইচ্ছার প্রকাশ’ বলে রুশাে অভিহিত করেছেন। সমাজে কোনাে ব্যক্তি আইন অমান্য করলে মনে করতে হবে যে সেই ব্যক্তি অপ্রকৃত ইচ্ছার (Unreal Will) দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এই অবস্থায় তাকে সাধারণ ইচ্ছার অনুগামী হতে অর্থাৎ আইন মান্য করে চলতে বাধ্য করা হবে।
প্রশ্ন ৯। আন্তর্জাতিক আইন কাকে বলে?
উত্তর: লরেন্সের (S. T. Lawrence) মতে, যে-সকল নিয়মকানুন দ্বারা সভ্য রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারিত এবং পারস্পরিক আচার-ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হয়, তাকেই আন্তর্জাতিক আইন বলে। অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক আইনকে আইন বলে স্বীকার করতে চান না।
প্রশ্ন ১০। আন্তর্জাতিক আইনের উৎস কী?
উত্তর: প্রথা ও চুক্তিকেই সাধারণভাবে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস বলে গণ্য করা হয়। আন্তর্জাতিক আদালতের বিধির ৩৮ ধারায় (Article 38, Statute of International Court of Justice) আন্তর্জাতিক আইনের যে উৎসগুলির কথা বলা হয়েছে সেগুলি হল—(ক) সাধারণ বা বিশেষ আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বারা সৃষ্ট নিয়মাবলি যা বিবদমান রাষ্ট্রগুলি স্বীকার করে নেয়, (খ) আইনের মতাে বাধ্যতামূলকভাবে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক প্রথাসমূহ, (গ) সভ্য রাষ্ট্রগুলির দ্বারা স্বীকৃত আইনের সাধারণ নিয়মাবলি এবং (ঘ) বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত ও খ্যাতনামা আইনবিদগণের প্রকাশিত রচনাসমূহ।
প্রশ্ন ১১। আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকৃত আইনের মর্যাদা দেওয়া যায় না কেন?
উত্তর: আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকৃত আইনের মর্যাদা দেওয়া যায় না। কারণ—(ক) আন্তর্জাতিক আইনগুলি সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট নয়। (খ) আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের শাস্তি দেবার ক্ষমতা নেই। (গ) প্রতিটি রাষ্ট্র সার্বভৌম বলে তাদের উপর বাধ্যতামূলকভাবে আইনকে চাপানাে যায় না। (ঘ) আন্তর্জাতিক আইন তৈরি করার জন্য কোনাে বিশ্ব আইনসভা নেই।
প্রশ্ন ১২। আইন ও নৈতিক বিধির মধ্যে মূল পার্থক্য কী?
উত্তর: প্রথমত, আইন মানুষের বাহ্যিক আচার-ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু নৈতিক বিধি বাহ্যিক আচার-আচরণ, চিন্তা সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। দ্বিতীয়ত, আইন রচিত হয়। কিন্তু নৈতিক বিধি নিয়ম মেনে রচনা করা হয় না। তৃতীয়ত, আইন সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট, কিন্তু নৈতিক বিধি অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট। চতুর্থত, আইনের পিছনে সার্বভৌম শক্তির সমর্থন থাকে, আইন ভঙ্গ করলে দৈহিক শাস্তি ভােগ করতে হয়। নৈতিক বিধি ভঙ্গের জন্য কোনাে দৈহিক শাস্তির সুযােগ থাকে না। নীতিহীন কাজের শাস্তি হল সামাজিক নিন্দা ও বিবেকের দংশন।
প্রশ্ন ১৩। স্বাধীনতা বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: স্বাধীনতা নেতিবাচক অর্থে নিয়ন্ত্রণবিহীনতা বােঝায়। কিন্তু ইতিবাচক অর্থে স্বাধীনতা বলতে আত্মবিকাশের সুযােগ বােঝায়। অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কির মতে, স্বাধীনতা বলতে সেই পরিবেশের সযত্ন সংরক্ষণ বােঝায়, যেখানে মানুষ জীবনের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ খুঁজে পায়।
প্রশ্ন ১৪। ব্যক্তিস্বাধীনতা বা পৌরস্বাধীনতা কাকে বলে? উদাহরণ দাও।
উত্তর: যে-সকল অধিকার ভােগ দ্বারা মানুষ তার ব্যক্তিসত্তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সাধন করতে পারে, তাকেই ব্যক্তিস্বাধীনতা বা পৌরস্বাধীনতা বলে। সম্পত্তির অধিকার, ধর্মের অধিকার, বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার উল্লেখযােগ্য উদাহরণ।
প্রশ্ন ১৫। স্বাধীনতা সম্পর্কে বুর্জোয়া ধারণা কী?
উত্তর: স্বাধীনতা সম্পর্কে বুর্জোয়া ধারণা সম্পূর্ণ নেতিবাচক। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটলে স্বাধীনতা ভােগ করা সম্ভব বলে এই তত্ত্বের সমর্থকরা বিশ্বাস করে। বুর্জোয়া ধারণায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা অপেক্ষা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অধিক গুরুত্ব পায়। বুর্জোয়া তত্ত্ব ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে পবিত্র বলে গণ্য করে। আর্থিক অসাম্য, স্বতঃস্ফূর্ততা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ এবং মুষ্টিমেয় বাছাই লােকের শাসন বুর্জোয়া স্বাধীনতার বৈশিষ্ট্য।
প্রশ্ন ১৬। স্বাধীনতা সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণা কী?
উত্তর: মার্কসীয় দৃষ্টিতে স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণবিহীনতা নয়। ইতিবাচক অর্থে সকল প্রকার শােষণের অবসানে মানুষের সামাজিক মুক্তির পথ প্রশস্ত করার কথা বলা হয়। স্বাধীনতা হল মানুষের পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযােগ যা শােষণভিত্তিক ব্যবস্থার অবসান ঘটলে সম্ভব হতে পারে। সুসংহত দৃষ্টিতে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে গ্রহণ করা হয়।
প্রশ্ন ১৭। রাজনৈতিক স্বাধীনতা কাকে বলে?
উত্তর: জনগণ যাতে দেশের শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করার সুযােগসুবিধা লাভ করে, সেই ব্যবস্থা থাকাই হল রাজনৈতিক স্বাধীনতা। যথা—ভােটদানের অধিকার, সরকারের গঠনমূলক সমালােচনার অধিকার প্রভৃতি।
প্রশ্ন ১৮। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থে দারিদ্র্য বা ক্ষুধার হাত থেকে মুক্তি বােঝায়। দৈনন্দিনের অন্নসংস্থানে যুক্তিসংগত অর্থ খুঁজে পাওয়ার সুযােগ ও নিরাপত্তা হল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। অধিকাংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন যে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভিন্ন সামাজিক বা রাজনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন। কর্মের অধিকার, অবকাশের অধিকার, বেকারবার্ধক্য ভাতা পাওয়ার অধিকার, অক্ষমতার রাষ্ট্র দ্বারা প্রতিপালিত হওয়ার অধিকার প্রভৃতি এর উদাহরণ।
প্রশ্ন ১৯। জাতীয় স্বাধীনতা বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: জাতীয় স্বাধীনতা বলতে বিদেশি শক্তির নিয়ন্ত্রণমুক্ততা বােঝায়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১৫ আগস্ট ইংরেজ শাসনমুক্ত হয়ে ভারত জাতীয় স্বাধীনতা লাভ করে।
প্রশ্ন ২০। আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক কী?
উত্তর: আপাতদৃষ্টিতে আইন ও স্বাধীনতা পরস্পরবিরােধী মনে হয়। মিল, স্পেন্সার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন যে, আইন রাষ্ট্র কর্তৃক ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুগ্ন বা খর্ব করে। কিন্তু একথা সত্য বলে গ্রহণ করা যায় না। স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত না হলে সবলের অত্যাচারে দুর্বলের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়। অধ্যাপক বাৰ্কার বলেন যে, প্রত্যেকের স্বাধীনতার প্রয়ােজনীয়তা সকলের স্বাধীনতার প্রয়ােজনীয়তার দ্বারা সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত। স্বাধীনতা সমাজের সকলের। সুতরাং, সকলের স্বাধীনতা সম্ভব করতে প্রত্যেকের অনিয়ন্ত্রণ স্বীকার করা যায় না। সুতরাং, রাষ্ট্রের আইন দ্বারা অনুমােদিত স্বাধীনতাই প্রকৃত স্বাধীনতা। আইনই স্বাধীনতার শর্ত বলা যায়।
প্রশ্ন ২১। সাম্য কাকে বলে?
উত্তর: সাধারণভাবে সাম্য বলতে সকলে সমান বােঝায়। বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায় যে, শারীরিক ও মানসিক গঠনের দিক থেকে মানুষে মানুষে পার্থক্য আছে। সুতরাং, সাম্য বলতে ব্যবহারের অভিন্নতা বোঝায়। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে সাম্য বলতে সুযােগের সমতা বােঝায়। মার্কসীয় দৃষ্টিতে সাম্য বলতে সমাজের শ্রেণিবিভাগ বিলােপের কথা বলা হয়। সকলের সমান সুযােগ এবং বিশেষ সুযােগসুবিধার অনুপস্থিতি—এই দুটিই হল সাম্যের মূলকথা।
প্রশ্ন ২২। সাম্য কয় প্রকার ও কী কী?
উত্তর: সাধারণ দৃষ্টিতে বিচার করলে সাম্যকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। এগুলি হল—(ক) সামাজিক সাম্য, (খ) আইনগত সাম্য এবং (গ) স্বাভাবিক সাম্য। এই আইনগত সাম্যের আবার তিনটি রূপ আছে-(i) অর্থনৈতিক সাম্য, (ii) রাজনৈতিক সাম্য এবং (iii) ব্যক্তিগত সাম্য।
প্রশ্ন ২৩। ল্যাস্কির মতে সাম্যের দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করাে।
উত্তর: (ক) কোনাে বিশেষ সুযােগসুবিধার অনুপস্থিতি এবং (খ) সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযােগসুবিধা।
প্রশ্ন ২৪। মার্কসবাদী দৃষ্টিতে সাম্য বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারবিশ্লেষণ করে একথা বলা যায় যে, প্রকৃত অর্থে সমাজে। সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে সামাজিক বৈষম্যের মূল কারণগুলিকে উৎপাটিত করতে হবে এবং সেইসঙ্গে এমন এক পরিবেশের সংরক্ষণ সুনিশ্চিত করতে হবে যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি তার যােগ্যতা অনুসারে ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের সুযােগ পায়। মার্কসবাদীদের মতে, বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় প্রকৃত সাম্য কখনােই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
প্রশ্ন ২৫। পুঁজিবাদী সমাজে সাম্যের প্রকৃতি পর্যালােচনা করাে।
উত্তর: সামন্তসমাজের গর্ভ থেকে উদ্ভূত পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিপতি শ্রেণি সাম্যের দাবিতে সােচ্চার হলেও পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় যে সাম্যের আদর্শের কথা ঘােষণা করা হয় তার প্রকৃতি ছিল মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক। কিন্তু এই সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সাম্যের অনুপস্থিতিতে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য অর্থহীন হয়ে যায়। যদিও পুঁজিবাদী সমাজই হল প্রথম সমাজ যেখানে আইনের চোখে সাম্যের দাবি প্রথম উখিত হয় এবং সাম্যের অধিকারের আইনগত স্বীকৃতির জন্য সংগ্রাম শুরু হয়।
প্রশ্ন ২৬। সামাজিক সাম্য কাকে বলে?
উত্তর: জাতি, ধর্ম, বংশ, বর্ণ বা অর্থ কৌলিন্যের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে প্রভেদ করা হলে সেখানে সামাজিক সাম্য থাকে না। কিন্তু যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বংশ প্রভৃতির ভিত্তিতে মানুষের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য করা হয় না, সেখানে সামাজিক সাম্য থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতকায় ও কৃয়কায় মানুষের মধ্যে সামাজিক দিক থেকে বৈষম্য করা হয়, তাই সেখানে সামাজিক সাম্য থাকে না।
প্রশ্ন ২৭। রাজনৈতিক সাম্য বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমান অধিকার ভােগের সুযােগকেই রাজনৈতিক সাম্য বলে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রীপুরুষ নির্বিশেষে, সুস্থ মস্তিষ্ক প্রাপ্তবয়স্কের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সমান সুযােগ থাকলে রাজনৈতিক সাম্য বর্তমান বলা যায়। নির্বাচন করা ও নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে সমান সুযােগকে রাজনৈতিক সাম্য বলা যায়।
প্রশ্ন ২৮। স্বাধীনতা ও সাম্যের সম্পর্ক কী?
উত্তর: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যাক্টন, টকভিল প্রমুখ মনে করেন যে, সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরােধী। সাম্যের জন্যে আবেগ স্বাধীনতাকে নির্মূল করে। বাস্তবে সাম্য স্বাধীনতার বিরােধী নয়, পরিপূরক। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে সমাজে বিশেষ সুযােগসুবিধার অস্তিত্ব থাকলে ব্যক্তির স্বাধীনতা সম্ভব হয় না। আর. এইচ. টনি বলেন, স্বাধীনতা বলতে যদি মানবাত্মার নিরবচ্ছিন্ন প্রসার বােঝায়, তাহলে একমাত্র সাম্যভিত্তিক সমাজেই সেই স্বাধীনতা সম্ভব। সুতরাং সাম্য কখনই স্বাধীনতার পরিপন্থী হতে পারে না।
প্রশ্ন ২৯। স্বাভাবিক সাম্য বলতে কী বােঝায়?
উত্তর: স্বাভাবিক সাম্য বলতে বােঝায় যে, মানুষ জন্মগত ভাবে সমান সুযােগসুবিধার অধিকারী। আমেরিকার স্বাধীনতা ঘােষণায় স্বাভাবিক সাম্যের তত্ত্ব স্বীকৃত হয়। কিন্তু জন্মগতভাবে দেহ মনে সব মানুষ সমান হতে পারে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মানুষের স্বাভাবিক বৈষম্যকে স্বীকার করেই সাম্য তত্ত্বে প্রচার করা হয়। বর্তমানে স্বাভাবিক সাম্য তত্ত্ব অবাস্তব বলে মনে করা হয়।
প্রশ্ন ৩০। সাম্যের মূলকথা কী?
উত্তর: বাস্তবক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে মানুষের দৈহিক ও মানসিক পার্থক্য থাকে। তাই সাম্য বললে ব্যবহারের অভিন্নতা বােঝায় না। অধ্যাপক ল্যাস্কির মত অনুসারে সাম্য বলতে মূলত দুটি বিষয় বােঝায়—(ক) বিশেষ সুযােগসুবিধার অনুপস্থিতি ও (খ) সকলের জন্য উপযুক্ত সুযােগসুবিধার ব্যবস্থা করা।
প্রশ্ন ৩১। সকল আইনই কি স্বাধীনতার সহায়ক?
উত্তর: সমাজবদ্ধ মানুষ কখনও অবাধ স্বাধীনতা ভােগ করতে পারে না। রাষ্ট্রীয় আইন বা নিয়ন্ত্রণের দ্বারা সকলের স্বাধীনতা ভােগ সম্ভব হয়। কিন্তু আইন সৃষ্টি হয় সরকারের দ্বারা। সরকার মুষ্টিমেয় ব্যক্তি নিয়ে গঠিত। সুতরাং, সরকারের আইন সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতার সহায়ক হতে পারেনা। ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী আইন মান্য করার অর্থ ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা। তাই আইন সর্বক্ষেত্রে স্বাধীনতার সহায়ক হয় না।
প্রশ্ন ৩২। ন্যায়ের ধারণাকে কটি দিক দিয়ে বিচার করা যায় ও কী কী?
উত্তর: ন্যায়ের ধারণাকে ৪টি দিক দিয়ে বিচার করা যায়। যেমন—(ক) আইনগত, (খ) রাজনৈতিক, (গ) সামাজিক ও (ঘ) অর্থনৈতিক।
প্রশ্ন ৩৩। ন্যায়ের সংজ্ঞা নির্ধারণে অসুবিধা কী?
উত্তর: ন্যায়ের ধারণা কোনাে স্বতন্ত্র ধারণা নয়, সমাজব্যবস্থার আচার-আচরণ ও মূল্যবােধের সঙ্গে ন্যায়ের ধারণা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।