Tuesday 7 April 2020

হরপ্পা সভ্যতা বা সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন দিক কেমন ছিল ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর

হরপ্পা সভ্যতা বা সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন দিক কেমন ছিল ?.

 প্রাচীন ভারতে সিন্ধু নদের তীরে এক উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, সেটি সিন্ধু সভ্যতা নামে পরিচিত । পড়ে মহেঞ্জোদারোতে এই সভ্যতার কেন্দ্র আবিষ্কার হয় । হরপ্পা কেন্দ্রটি ছিল অনেক বড়ো । তাই এই সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতা নামেও পরিচিত । ১৯২০ সালে হরপ্পা ও ১৯২১ সালে মহেঞ্জোদারো নামে দুটি কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয় । হরপ্পা সভ্যতাকে প্রায় ইতিহাস যুগের সভ্যতা বলা হয় । কারণ এখানে প্রাপ্ত লিপিগুলি পড়া সম্ভব হয়নি । এখানের মানুষেরা তামা ও ব্রোঞ্জ ধাতুর ব্যবহার করত । সময়কাল হিসাবে ধরা হয় আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ পর্যন্ত । এই সভ্যতার বিস্তার ছিল প্রায় সাত লক্ষ বর্গ কিলোমিটার । সীমানা ছিল উত্তরে আফগানিস্তান, জম্বুর মান্ডা অঞ্চল, দক্ষিণে মহারাষ্ট্রের দৈমাবাদ, কচ্ছ, গুজরাত অঞ্চল, পূর্বে আলমগির পুর, পশ্চিম সীমা পাকিস্তানের বালুচিস্তান পর্যন্ত ।


 চার্লস ম্যাসন পাঞ্জাবের সাহিওয়াল জেলায় গিয়েছিলেন ১৮২৬ সালে । তিনি ধারণা করেন যে এখানে আলেকজান্ডার ও পুরুর যুদ্ধ হয়েছিল । এরপর আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৫০ সালে এই এলাকায় যান । তিনি প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে উৎসাহী ছিলেন । তিনি সেখানে দেখেন যে ইট ব্যবহার করা হচ্ছে রেল লাইন বানানোর কাজে । সেখানে সেই ইটের সাথে কিছু লিপি ও বাসনপত্র পাওয়া যায় । কেউ এবিষয়ে তেমন গুরুত্ব তখন দেননি । শেষে ১৯২০ সালে দয়ারাম সাহানি হরপ্পায় এবং ১৯২১ সালে মহেঞ্জোদারোতে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় খননকার্য করেন । জন মার্শাল ১৯২৪ সালে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সম্পর্কে বিবরণ পেশ করলে বিশ্ববাসী সবিস্তাতে এই সভ্যতার কথা জানতে পারেন ।
 এখানে শাসক কারা বা কে ছিলেন সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়না । মহেঞ্জোদারোতে একটি পুরুষের মূর্তি পাওয়া গেছে । তাঁর চোখ আধবোজা, চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো, গালে চাপদাড়ি, আবার বা কাঁধে চাদর আছে । ইনি কি তবে হরপ্পার রাজা না পুরোহিত তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে । আবার অনেকের মতে – ইনি একজন পুরোহিত রাজা । তবে এর নিশ্চিত প্রমাণ এখন পাওয়া যায়নি ।
 হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো ছিল দুটো বড়ো নগর । হরপ্পা সভ্যতাতে প্রথম নগর তৈরি হয়েছিল । অনেকে তাই একে প্রথম নগরায়ন বলেন । এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় যেমন – বানাওয়ালি, ঢোলবিরা, কুনতাসি, কালিবঙ্গান, লোথাল, সুর কোটাডা ইত্যাদি ছোটো বড়ো শহর পাওয়া গেছে । হরপ্পার নগরগুলিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল । একদিকে থাকত উঁচু এলাকা যাকে সিটাডেল বলা হয় । এটি একটি উঁচু ঢিপির উপর বানানো হত । নগরগুলি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা থাকত ।
মহেঞ্জোদারোতে ১৮০ ফুট/১০৮ ফুটের একটি স্নানাগার পাওয়া গেছে । এতে জল পরিষ্কার করার ব্যবস্থা ছিল । জল ঢোকানো ও জল বের করে দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল । এর চারিদিকে ৮ ফুট উঁচু ইটের দেওয়াল ছিল ও চারপাশে ছোটো ছোটো ঘর ছিল । হরপ্পায় খাদ্য মজুত করে রাখার জন্য পাকা ঘরের মত দুটি কেন্দ্র তৈরি করা হয় । সেখানে শুকনো খাদ্যশস্য রাখার ব্যবস্থা ছিল । হাওয়া চলাচলের জন্য দেওয়ালের গায়ে অনেক ঘুলঘুলি ছিল । পাশে থাকা ঘরগুলি শস্য পেষাই করা শ্রমিকদের বলে মনে করা হয় ।
 শহরের উঁচু অংশগুলিতে সম্ভবত প্রশাসকরা থাকতেন । সেগুলি আবার দুর্গ ও পরিখা দিয়ে ঘেরা থাকত । এখানে একটি বাড়ি পাওয়া গেছে প্রায় ৩০০ বর্গ মিটার এলাকা নিয়ে তৈরি । রাস্তাগুলি ছিল চওড়া, নর্দমাগুলি ছিল ঢাকা দেওয়া । প্রতিটি বাড়িতে উন্নত জল নিকাশি ব্যবস্থা ছিল । উঁচু এলাকা গুলিতে বড়ো বড়ো বাড়ি তৈরি করা হত । নিচু এলাকায় থাকত ছোটো ছোটো বাড়ি । রাস্তার ধারে জলের কুয়ো ছিল । প্রায় বাড়িতে শৌচাগারের ব্যবস্থা ছিল । একতলা, দোতলা বাড়ি গুলি পড়া ইটের তৈরি । প্রত্যেক বাড়ির ছোটো নালা বড়ো নর্দমায় গিয়ে পড়েছে ।
 নদীর তীরবর্তী জমি ছিল উর্বর, আবার জলসেচের সুবিধা পাওয়া যায় । তাই চাষের কাজের সুবিধার জন্য এখানের অধিবাসীরা নদীর তীরে বসবাস করতেন । নগরের বাইরে গ্রামীণ এলাকায় কৃষিজীবী মানুষরা বাস করতেন ।  গ্রামে যব, গম, সরষে, নানা প্রকারের ডাল ও ধানের চাষ হত । তবে, ধানের ফলন সব জায়গায় হত কিনা এর প্রমাণ পাওয়া যায়না ।  এছাড়াও তিল, তুলোর চাষ করা হত । কৃষিকাজ ছাড়া এখানে পশু পালন করা হত । প্রধান পশু ছিল – ভেড়া, ছাগল, ষাঁড়, উট ইত্যাদি । ঘোড়ার ব্যবহার তাঁরা জানতোনা বলে মনে করা হয় । কৃষির পাশাপাশি এখানকার মানুষরা যে বাণিজ্য করত তার প্রমাণ আমরা পাই, মেসোপটেমিয়ায় পাওয়া হরপ্পায় তৈরি তেইশটি সিলমোহর থেকে । এরফলে আমরা জানতে পারি যে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল । আবার মেসোপটেমিয়ার একটি সিলমোহর এখানে পাওয়া গেছে । তাছাড়াও ইরান, তুর্কমেনিস্তানে হরপ্পার শিল্পদ্রব্যের খোঁজ পাওয়া গেছে । তাঁরা সাধারণত স্থলপথে ও জলপথে বাণিজ্য করত । বিদেশ থেকে আমদানি করা হত দামি পাথর, হাতির দাঁত, চিরুনি, সোনা, তামা, রুপো । আর রপ্তানি করা হত তেল, পশম, ময়দা ও বার্লি জাতীয় দ্রব্য ।
 যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য হরপ্পার অধিবাসীরা পশুর টানা গাড়ি, নৌকা ও জাহাজের ব্যবহার করত । পশু হিসাবে গাধা, বলদ, উঠ ইত্যাদি ব্যবহার হত ।  বলদের ব্যবহার গাড়ি টানার জন্য ব্যবহার বেশি হত । নানা রকম চাকার গাড়ির ব্যবহার হত । গাড়ির পাশাপাশি নৌকা ব্যবহার হত, কারণ – নদীপথে যাতায়াতের সময় অনেক কম লাগত । পালতোলা নৌকার ব্যবহার হত, যাতে হাওয়া ও স্রোতের সাহায্যে সহজে যাতায়াত করা যেত । যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক বেশি নদীর ওপর নির্ভর করত ।
 অনেক কারিগরি শিল্পের বিকাশ এখানে ঘটেছিল । নানা ধরণের বাসনপত্র, বাটালি, ছুরি, কুঠার, ইত্যাদি বানাত । এখানের মানুষরা লোহার ব্যবহার জানত না । পাথর ও ধাতু দিয় বিভিন্ন জিনিস তাঁরা বানাত । কাঁসা, তামা, ব্রোঞ্জ ইত্যাদি ব্যবহার করতো । মাটির পাত্র যেমন – থালা, বাটি, জালা ইত্যাদি তৈরি করতো । মাটির পাত্র তৈরি করার পর আগুনে পুড়িয়ে নানা নকসা তৈরি করতো । মাটি পুড়িয়ে নারীমূর্তি, পশুপাখির মূর্তি ইত্যাদি বানাত । অনেক রকম মালা ব্যবহার হত । তাঁরা সোনা, তামা, শাঁখ, হাতির দাঁত, নীলচে লাজুলি পাথর মালা ও গয়না হিসাবে ব্যবহার করতো ।
 হরপ্পার লিপিগুলি ঠিকমত পড়া যায়নি । তাই এর থেকে তেমন কিছু জানা যায়না । লিপিগুলি সাংকেতিক ভাবে ছিল, তাতে ৩৭৫ থেকে ৪০০ টির মত চিহ্ন রয়েছে । এই লিপিগুলি লেখা ডান দিক থেকে বাম দিকে । ছোটো ছোটো চিহ্ন গুলিকে সংখ্যা বলে মনে করা হয় । তামার ফলক, সিলমোহরের উপর হরপ্পার লিপি পাওয়া গেছে । অনুমান করা হয় দ্রাবিড় ভাষার সাথে এর মিল রয়েছে । যে সিলমোহর এখানে পাওয়া গেছে সেগুলি নরম পাথর কেটে তৈরি করা । সিলমোহরে একটি এক শিং ওয়ালা পশুর মূর্তির ছাপ ও লিপির ব্যবহার দেখা যায় । এছাড়াও মানুষ, গাছ, ষাঁড়, জ্যামিতিক নকসা দেওয়া সিলমোহর পাওয়া গেছে । এগুলিতে সাদা জিনিস মাখিয়ে পোড়ানো হত ।
 হরপ্পায় অনেক নারী মূর্তি পাওয়া গেছে, এরফলে মনে করা হয় যে এখানে মাতৃ পূজার প্রচলন ছিল । একটি যোগী পুরুষের মূর্তি পাওয়া গেছে । এর চারপাশে রয়েছে বাঘ, গণ্ডার ইত্যাদি জন্তু । অনেকে একে আদি পশুপতি শিব বলেন । এক শিং ওয়ালা কাল্পনিক পশুর মূর্তির পূজা হত । ধর্মীয় কাজে এখানে জলের ব্যবহার হত ।
হরপ্পা সভ্যতা বিভিন্ন কারণে অবনতি হয়েছিল । অতিরিক্ত গাছ কাটার ফলে বৃষ্টিপাত কমে যায়, ফলে কৃষিকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় । আবহাওয়া পরিবর্তনের হয়ে শুষ্ক জলবায়ু দেখা যায় । অনেকে মনে করেন যে সিন্ধু নদীর বন্যার ফলে এই সভ্যতা অবনতি হয় । পাচিলে কাদার চিহ্ন পাওয়া গেছে । বন্যার ফলে এই অবস্থা বলে অনুমান করা হয় । বাণিজ্যে ভাটা পড়ার জন্য নগর ও শাসন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায় । অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেয় । এছাড়াও আরও বিভিন্ন কারণে হরপ্পা সভ্যতা দুর্বল হয়ে পড়ে ।
 আমাদের লেখা আপনার কেমন লাগছে ও আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নীচে কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্টটি পৌঁছে দিতে দয়া করে শেয়ার করুন । ইতিহাস বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে নিচে ইতিহাস লেখাটির উপর ক্লিক করুন । পুরো পোস্ট টি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ  
Comment

Class XI Political Science

Class XII Political Science

Class 12 Bangla Books Question& Answers