Tuesday 7 April 2020

মধ্য যুগ ভারতের ইতিহাস বিজয়নগর সাম্রাজ্য

Short Notes on Vijayanagara Empire (বিজয়নগর সাম্রাজ্য)

  • মহম্মদ বিন তুঘলক এর আমলে দাক্ষিণাত্যে তুর্কি মুসলমানদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া, এই হিন্দু রাজ্যের উৎপত্তির প্রেরণা দিয়েছিল।
  • সঙ্গম বংশীয় হরিহর ও বুক্ক ছিলেন বিজয়নগর রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। প্রথমে এরা বরঙ্গল এর কাকতীয় বংশের সামন্ত হিসাবে নিয়োজিত ছিলো। সুলতানী বাহিনী বরঙ্গল আক্রমণ করলে এই দুই ভাই হোয়সাল রাজ্যে এসে সেখানকার চাকুরী গ্রহণ করেন। সুলতানী বাহিনী হোয় সাল রাজ্য আক্রমণ করলে এই দুই ভাই তাদের হাতে ধরা পড়ে এবং দুই ভাই কে বন্দী করে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়।
  • দাক্ষিনাত্যে দিল্লির সুলতানী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে হয়ে যাওয়া হিন্দু বিদ্রোহ কে দমন করতে মহম্মদ বিন তুঘলক এদের আনে গুন্ডিতে শাসক পদে নিযুক্ত করেন। পরে সুযোগমতো এঁরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন বিজয়নগর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
  • রাজ্যের উত্তর দিকে মুসলমান শাসিত বাহমনী রাজ্য ছিল বিজয় নগরের সবথেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে বাহমনী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জনৈক আফগান সৈনিক আলাউদ্দিন হুসেন শাহ। তিনি বাহমান শাহ উপাধি নিয়েছিলেন। তাই তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজ্য বাহমনী রাজ্য নামে পরিচিতি লাভ করে।
  • এই দুই রাজ্যের মধ্যে সংঘাত ছিলো অনিবার্য পরিণতি। তবে হিন্দু মুসলমান বলেই এই দুটি রাজ্যের মধ্যে সংঘাত ছিল তাই নয়, দাক্ষিনাত্যে রাজনৈতিক প্রাধান্য অর্জন করাই ছিলো এই সংঘর্ষের মূল কারণ। এছাড়া কৃষ্ণা ও তুঙ্গাভদ্রা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল , কৃষ্ণা ও গোদাবরী উপকূল অঞ্চল এবং কোঙ্কন ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের দখল নিয়ে এই দুই রাজ্যের সংঘর্ষ এক দীর্ঘ স্থায়ী সংঘর্ষে পরিণত হয়। রাজ্য দুটি ধ্বংস হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্তও বিজয়নগর ও বাহমনি রাজ্য দুটির মধ্যে লাগাতার সামরিক সংঘাত চলেছিল। ধ্বংসের কাজে কোনো পক্ষই পিছিয়ে ছিল না।
  • বিজয়নগর রাজ্যে চারটি রাজবংশ রাজত্ব করেছিল। সেই চারটি রাজবংশ হলো সঙ্গম, সালুভ, তুলুভ, আড়বিডু।
  • প্রথম দেবরায় এর পুত্র দ্বিতীয় দেবরায় ছিলেন সঙ্গম বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি। তিনি সামরিক বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধিতে বিশেষ জোর দিয়েছিলেন।
  • তুলুভ বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন বীর নরসিংহ এর সৎ ভ্রাতা কৃষ্ণদেব রায়। তিনি কেবল তুলুভ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন না, অনেকেই তাঁকে বিজয়নগরের সমস্ত রাজার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম শাসক বলে মনে করেন। কৃষ্ণদেব রায় মামুদ শাহ কে বাহমনি রাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। এই কাজকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তিনি “যবন রাজ্য স্থাপন আচার্য” উপাধি নেন। তিনি তাঁর কূটনৈতিক বিচক্ষণতার মাধ্যমে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেন। পর্তুগিজ বণিকদের সঙ্গেও ছিল তাঁর উদার সম্পর্ক। তাঁদের কাছ থেকে উন্নত মানের অস্ত্র কিনে তিনি তাঁর সেনাবাহিনী কে শক্তিশালী করেন। কেবল সুযোদ্ধা নয়, বিচক্ষণ শাসক ও সংস্কৃতি মনস্ক ব্যাক্তি হিসাবেও রাজা কৃষ্ণদেব রায় সমসাময়িক লেখক দের প্রশংসা অর্জন করেছেন। পর্তুগিজ পর্যটক ও বণিক পায়েজ, নুনিজ, বারবোসা প্রমুখ কৃষ্ণ দেব রায় এর রাজসভায় বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন।
  • দেশের আট জন প্রখ্যাত পণ্ডিত তাঁর রাজসভা অলংকৃত করতেন। তাঁর আমল ছিল তেলেগু ভাষার স্বর্ণযুগ। তিনি নিজে একাধিক সাহিত্য রচনা করেছেন। সেগুলির মধ্যে দুটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। এগুলির একটি হলো তেলেগু ভাষায় রচিত রাষ্ট্রদর্শন বিষয়ক গ্রন্থ “আমুক্তমাল্যদা” এবং সংস্কৃত ভাষায় রচিত নাটক “জাম্ববতি কল্যাণম”। অল্লসনি পেড্ডন ( peddan) এইসময় অন্ধ্র কবিতা পিতামহ নামে সম্মানিত ছিলেন। তাঁর রচিত কাব্য হল মনুচরিতম। “অষ্টদিগগজ” ছাড়াও তিনি প্রতি বছর বসন্ত উৎসবের সময় বিভিন্ন সাহিত্যিক দার্শনিক দের আমন্ত্রণ জানিয়ে মূল্যবান উপহার দিতেন।
  • নির্মাতা হিসাবেও তাঁর সুনাম ছিল। বিজয়নগরের অনতিদূরে মাতা নাগলম্ব-র স্মৃতির উদ্দেশ্যে তিনি একটি সুসজ্জিত নতুন শহর নির্মাণ করেন। এই শহর নাগালপুর নামে পরিচিত হয়। এছাড়া কৃষ্ণ মন্দির, হাজার স্বামীমন্দির , বিঠল মন্দির প্রভৃতি তাঁর স্থাপত্য কীর্তি ও ধর্মভাবনার অন্যতম কীর্তি।
  • ধর্মীয় উদারতা ও পরধর্ম সহিষ্ণুতা ছিল কৃষ্ণদেব রায়ের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি নিজে বৈষ্ণব হলেও সকল ধর্মের প্রতি ছিল তাঁর সমান শ্রদ্ধাবোধ। মোট কথা তিনি ছিলেন একজন পরিপূর্ণ শাসক। দক্ষিণ ভারতের অন্য কোনো শাসকদের মধ্যে এমন বহুমুখী প্রতিভা ও গুণের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায় না।
  • কৃষ্ণদেব রায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিজয় নগরের পতনের পথও প্রশস্ত হয়। মৃত্যুর কিছু পূর্বে তিনি তাঁর নাবালক পুত্র কে সিংহাসনে বসিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতে শুরু করেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রের দ্বারা এই পুত্রের মৃত্যু হলে তিনি জনৈক আত্মীয় অচ্যুত রায় কে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান।
  • কৃষ্ণদেব রায়ের মৃত্যু হলে তাঁর শ্যালক রাম রায় সিংহাসন দাবি করে বসেন। এর ফলে বিজয়নগরের অভ্যন্তরে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। বিজয় নগরের অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে উড়িষ্যার রাজা গজপতি এবং বিজাপুরের রাজা ইব্রাহিম আদিল শাহ বিজয়নগর আক্রমণ করে বসেন। এইভাবে এক ডামাডোল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই বিজয় নগরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এগোতে থাকে।
  • অচ্যুত রায়ের মৃত্যুর পর সদাশিব রায় সিংহাসনে বসেন। তাঁর আমলে প্রকৃত ক্ষমতা ন্যস্ত ছিলো রাম রায় এর হাতে।
  • রাম রায় মুসলিম রাজ্য গুলিতে কূটনীতির দ্বারা বিরোধ ও বিভেদ সৃষ্টি করে তাদের ক্ষমতা খর্ব করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি তাৎক্ষণিক সাফল্য ও অর্জন করেন কিন্তু অচিরেই তাঁর এই কূটনৈতিক উদ্দেশ্য মুসলিম রাজ্য গুলির কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
  • আহম্মদ নগর, বিজাপুর, গোলকুন্ডা, বিদর এই জোটের মুখ্য নায়ক ছিল বিজাপুরের আলি আদিল শাহ। বেরার এই জোটের বাইরে থাকে। জোট বাঁধার পর আদিল শাহ রাম রায়ের কাছে রায়চুর, মুদগল দাবি করেন। স্বাভাবিক ভাবেই রাম রায় এই অন্যায় দাবি নস্যাৎ করে দেন। সঙ্গে সঙ্গেই মুসলমান রাজ্যের এই শক্তি জোট বিজয় নগরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা শুরু করে।
  • “রাখখস” ও “তাংদি” নামক গ্রামের সন্নিকটে শুরু হয় এই সংগ্রাম। এটিই ইতিহাসে তালিকোটার যুদ্ধ ( ১৫৬৫) নামে খ্যাত। রাম রায় ও তাঁর দুই ভাই বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেন কিন্তু শেষপর্যন্ত বিজয়নগর পরাজিত হয়। বিজয় নগরের দুই মুসলমান সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতায় মুসলিম জোট বিজয়ী হয়। রাম রায় কে হত্যা করা হয়।
  • ডক্টর ঈশ্বরীপ্রসাদ তালিকোটার যুদ্ধকে বিজয়নগর রাজ্যের মৃত্যু ঘণ্টা বলে অভিহিত করে লিখেছেন যে , এই যুদ্ধে বিপর্জয়ের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা বিজয় নগরের পক্ষে সম্ভব হয় নি। মুসলমান রাজ্য গুলির পক্ষেও এই যুদ্ধ শুভ ছিল না। তারা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে নিজেদেরই ধ্বংস ডেকে এনেছিল। তাই বলা চলে “তালিকোটার যুদ্ধ” যদি বিজয়নগর রাজ্য কে ধ্বংস করে, তাহলে এই যুদ্ধই মুসলমান রাজ্য গুলির পতনের পথও প্রশস্ত করেছিল।
  • বিজয়নগর রাজ্যের সামরিক ব্যাবস্থা ও ভূমিদান রীতির সাথে বিশেষ ভাবে জড়িত ছিল “নায়ক” বা
    “নায়ঙ্কারা” প্রথা। নায়ক দের অধিকার, কর্তব্য, ও নায়ক প্রথার প্রকৃতি সম্পকে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে শেষ পর্যন্ত নীলকন্ঠ শাস্ত্রী , মহালিঙ্গম-এর কথায় মূল কথা বলে বিবেচিত হয়। তাঁরা লিখেছেন যে, বিজয়নগরের অভ্যন্তরীণ সংগঠনের প্রধান ভিত্তি ছিল “নায়ঙ্কারা ব্যাবস্থা”। এই প্রথা অনুযায়ী রাজা নায়ক দের হাতে ভূমিরাজস্বের অধিকার অর্পণ করতেন। তাঁরা ছিলেন একাধারে সামরিক নেতা ও স্থানীয় প্রশাসক। তামিল দেশে পনেরো শতকের শেষভাগ ও ষোলো শতকের গোড়ায় এই ব্যাবস্থার ব্যাপকতা দেখা যায়।
  • এ যুগে শিল্প ও বাণিজ্যে “গিল্ড” বা বণিক সংঘের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। পর্যটক আব্দুর রজ্জাক লিখেছেন যে, এক এক ধরনের শিল্প ও ব্যাবসার জন্য এক একটি স্বতন্ত্র গিল্ড বা সংঘ গড়ে উঠত। অন্যান্য পর্যটক দের রচনাতেও গিল্ড ব্যাবস্থার উল্লেখ পাওয়া যায়। বিনিময় প্রথার মাধ্যম হিসাবে সোনা ও তামার মুদ্রার প্রচলন ছিল বেশি।
  • মুদ্রাতে দেবদেবীর মূর্তি ও পশু পাখির ছবি খোদাই থাকতো।
  • উচ্চ,মধ্য, নীচ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হতো না। মোটামুটি এক আর্থিক সচ্ছলতা পরিলক্ষিত হতো বিজয় নগরে।
  • নারীদের বিশেষ মর্যাদা ছিল বিজয় নগরে। রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে নারীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। নুনিজের বর্ণনা থেকেও জানা যায় যে, বিজয়নগরের রাজা নারী মল্ল যোদ্ধা, নারী দ্বাররক্ষী, নারী হিসাবরক্ষক নিয়োগ করতেন। সমাজে বাল্য বিবাহ, পুরুষদের বহু বিবাহ এবং সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল।
  • কেবল ব্রাহ্মণ ছাড়া বিজয়নগরের অধিকাংশ মানুষ ই ছিল মাংসভোজী। রাজাও মাংস ভক্ষণ করতেন। তবে গরু ও বলদের মাংস খাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।
  • পর্যটক দের মতে সেই সময় সাহিত্য ও শিল্প সংস্কৃতিতে বিজয় নগরের খ্যাতি ছিল সর্বজন বিদিত। সংস্কৃত, তেলেগু, তামিল ও কানাড়ি ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। সংস্কৃত মুক্ত তামিল ভাষা সাহিত্যের বিকাশ এ যুগের অন্যতম প্রধান অবদান। বেদের ভাষ্যকার সায়নাচার্য এবং তাঁর ভাই মাধব বিদ্যারণ্য বিজয় নগর রাজ্যটি কে একটি সাংস্কৃতিক ভিত্তি দেন।
  • শিল্প স্থাপত্যের প্রতিও বিজয়নগরের রাজাদের সহজাত আকর্ষণ ছিল। আব্দুর রজ্জাক, পায়েজ প্রমুখ বিজয়নগর শহরটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিশেষত রাজপ্রাসাদের নির্মাণশৈলী ও তাঁর ঐশ্বর্য্য তাঁদের হতবাক করেছে বার বার।
  • একটি হিন্দু রাজ্য হলেও ধর্মীয় অনুদারতা কখনো এই রাজ্যকে গ্রাস করতে পারেনি। নাগরিক দের ধর্মাচরণ এর ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা ছিল। সামরিক বাহিনীতে বহু মুসলমান সদস্য ছিল।
  • তাই বলা যেতে পারে বিজয়নগর রাজ্য তাঁর আপন ঐতিহাসিক মহিমায় ইতিহাসে এক উল্লিখিত স্থান দখল করে আছে।
Comment

Class XI Political Science

Class XII Political Science

Class 12 Bangla Books Question& Answers