চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র (১৮৭৬-১৯৩৮) কথাশিল্পী। ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর হুগলি জেলার দেবানন্দপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কৈশোর ও প্রথম যৌবন কাটে ভাগলপুরে মাতুলালয়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি দেবানন্দপুরের হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল ও ভাগলপুরের দুর্গাচরণ এম ই স্কুলে অধ্যয়ন করেন। তারপর টিএন জুবিলি কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৮৯৪) পাসের পর একই কলেজে এফএ শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্তু দারিদ্রে্যর কারণে তাঁর শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটে।
অধ্যয়নে বিরতি ঘটার পর শরৎচন্দ্র বনেলি স্টেটে সেটেলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক এবং বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি পদে চাকরি করেন। এক সময় তিনি সন্ন্যাসিদলে যোগ দেন এবং গান ও নাটকে অভিনয় করেন। শরৎচন্দ্র কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।
শরৎচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস বড়দিদি (১৯০৭) ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যজগতে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তিনি একে একে বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য (১৯১৪), পরিণীতা (১৯১৪), বৈকুণ্ঠের উইল (১৯১৬), পল্লীসমাজ (১৯১৬), দেবদাস (১৯১৭), চরিত্রহীন (১৯১৭), নিষ্কৃতি (১৯১৭), শ্রীকান্ত (৪ খন্ড, ১৯১৭-৩৩), দত্তা (১৯১৮), গৃহদাহ (১৯২০), দেনা-পাওনা (১৯২৩), পথের দাবী (১৯২৬), শেষ প্রশ্ন (১৯৩১) ইত্যাদি গল্প-উপন্যাস এবং নারীর মূল্য (১৯২৩), স্বদেশ ও সাহিত্য (১৯৩২) প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেন। এগুলির মধ্যে শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন, গৃহদাহ, দেনা-পাওনা এবং পথের দাবী খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর পথের দাবী উপন্যাসটি বিপ্লববাদীদের প্রতি সমর্থনের অভিযোগে ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পর শরৎচন্দ্র ও ছাত্রসমাজ, ছেলেবেলার গল্প, শুভদা (১৯৩৮), শেষের পরিচয় (১৯৩৯), শরৎচন্দ্রের গ্রন্থাবলী (১৯৪৮) এবং শরৎচন্দ্রের অপ্রকাশিত রচনাবলী (১৯৫১) প্রকাশিত হয়।
শরৎচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের একজন অমর কথাশিল্পী। তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয় পল্লীর জীবন ও সমাজ। ব্যক্তিমানুষের মন পল্লীর সংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতার আঘাতে কতটা রক্তাক্ত হতে পারে, তারই রূপচিত্র এঁকেছেন তিনি তাঁর রচনায়। তবে তাঁর উপন্যাসে ব্যক্তিবর্গের ইচ্ছাভিসার ও মুক্তি সর্বদাই সমাজ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয় বলে তাঁকে রক্ষণশীলও বলা হয়ে থাকে। তবে নারীর প্রতি সামাজিক নির্যাতন ও তার সংস্কারবন্দি জীবনের রূপায়ণে তিনি বিপ্লবী লেখক, বিশেষত গ্রামের অবহেলিত ও বঞ্চিত বাঙালি নারীর প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ ও শ্রদ্ধা তুলনাহীন। সামাজিক বৈষম্য, কুসংস্কার ও শাস্ত্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। কাহিনী নির্মাণে অসামান্য কুশলতা এবং অতি প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষা তাঁর কথাসাহিত্যের জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির প্রধান কারণ। বাংলাসহ ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় তাঁর অনেক উপন্যাসের চিত্রনাট্য নির্মিত হয়েছে এবং সেগুলি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে, যথা: দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি। শরৎচন্দ্র চিত্রাঙ্কনেও দক্ষ ছিলেন। বার্মায় বসবাসকালে তাঁর অঙ্কিত ‘মহাশ্বেতা’ অয়েল পেইন্টিং একটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম।
সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য শরৎচন্দ্র কুন্তলীন পুরস্কার (১৯০৩), জগত্তারিণী স্বর্ণপদক (১৯২৩), বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্যপদ (১৯৩৪) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি (১৯৩৬) লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।