ভূমিকা: জন ডিউই এর শিক্ষা চিন্তা আধুনিক যুগে পৃথিবীর সব দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে প্রভাবিত করেছে। তাঁর শিক্ষাদর্শন একদিকে যেমন আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রচিত তেমনি অন্যদিকে যন্ত্রসভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সমতা রেখে তা সংগঠিত। তাঁর শিক্ষা দর্শনের মধ্যে এই দুই উপাদানের সার্থক সমন্বয় আমরা দেখতে পাই। তিনি যে শুধু শিক্ষার তাত্ত্বিক দিকের ওপর আলোকপাত করেছেন তাই নয়, পরীক্ষামূলক ভাবে তাঁর শিক্ষা চিন্তাকে প্রয়োগ করার চেষ্টাও করেছিলেন। ১৯০১ সালে তিনি তাঁর গবেষণামূলক বিদ্যালয় স্থাপন করে, সেখানে তাঁর শিক্ষামূলক চিন্তা-ভাবনাকে প্রয়োগ করেন।
শিক্ষা দর্শন: ডিউই এর ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি ও গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ সে সময় খুবই সাড়া জাগিয়েছিল। শিক্ষাকে জীবনের সমার্থক ভেবে এই দুয়ের মধ্যে এক বছর সম্পর্ক সৃষ্টি করেছেন তিনি এবং জীবনকে ঘিরে দর্শন ও শিক্ষার মধ্যে একটি নিবিড় বন্ধন স্থাপন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে আদর্শবাদ, প্রকৃতিবাদ ও অন্যান্য বিশেষ ধর্মীয় মতবাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার ধারাকে সমপ্রসারণের মহান দায়িত্ব বহন করেছেন জন ডিউই। রুশোর পরে শিক্ষার প্রস্তুতি প্রণয়নে, শিক্ষার পাঠ্যক্রম, পন্থা পদ্ধতি ও প্রশাসনিক পরিচালনার নীতি নির্ধারণে ডিউই তাঁর নিজস্ব শিক্ষানীতি সাপেক্ষ পথ নির্দেশ দানে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য উদঘাটনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন।
শিক্ষার লক্ষ্য: জীবনের যেমন কোনো চিরস্থায়ী সত্য থাকতে পারে না, এমনি শিক্ষাতেও তেমন কোনো স্থায়ী লক্ষ্য নির্ধারণ করা যায় না। প্রতিটি শিশুর পৃথক পৃথক অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার সর্বাঙ্গীন, সুষম ও সর্বোত্তম বিকাশের জন্য শিক্ষা কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করেন তিনি। তাই শিক্ষার স্থায়ী লক্ষ্যের কথা তিনি বলেননি। শিক্ষার্থীর জীবনব্যাপী প্রক্রিয়ার সাথে সংযোগ রেখে শিক্ষার লক্ষ্যকে তিনি আরো জ্ঞান, আরো বৃদ্ধি, বিকাশ, আরো সামাজিক দক্ষতা লাভ এবং আরো বেঁচে থেকে আরো অভিজ্ঞতা ও আরো শিক্ষা পাওয়ার সাথে সমান ভেবেছেন। তাঁর মতে, শিক্ষার কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ না থাকলেও শিক্ষার কাজ হবে সামাজিক পরিবেশে শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার সর্বোত্তম বিকাশ।
পাঠ্যক্রম: পাঠ্যক্রম বলতে ডিউই সকল রকম অভিজ্ঞতাকে বুঝিয়েছেন। শিশু আত্মসচেতনভাবে যেসব কাজ করবে এবং যতসব অভিজ্ঞতা অর্জন করবে, তাই হবে তার পাঠ্যক্রম। তার মতে পাঠ্যক্রম বাইরের কোন ব্যক্তি বা সংস্থা দ্বারা শিশুর উপর আরোপিত জ্ঞানের সমষ্টি নয়। প্রত্যেক শিশু তার নিজের আগ্রহ ও প্রবণতা অনুযায়ী পাঠ্যক্রম রচনা করবে। এই কারণে তিনি শিক্ষার কোন স্তরের জন্য নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম রচনা করে দেননি।
ডিউই এর পাঠক্রম রচনার মৌলিক নীতিসমূহ: ডিউই পাঠক্রম সম্পর্কে কতগুলি মন্তব্য করেছেন। মন্তব্যগুলি নিম্নরূপ--
১) পাঠক্রমের বিষয়বস্তু নির্ধারণের ক্ষেত্রে, তিনি বৃত্তিমূলক কাজ ও হাতের কাজের উপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন।
২) শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও ধর্মীয় চেতনাকে জাগ্রত করার জন্য উপযুক্ত কর্মসূচি পাঠ্যক্রমের মধ্যে রাখতে হবে।
৩) শিক্ষার্থীর পাঠ্যক্রমকে তার সমাজ জীবনের চাহিদার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত করতে হবে।
৪) পাঠক্রম রচনার সময় শিশুর সামাজিক চাহিদা এবং তার মানসিক বৈশিষ্ট্য এই উভয় দিকের উপর সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
শিক্ষণ পদ্ধতি: ডিউই শিক্ষাকে মনোবিদ্যা সম্মত করারও পক্ষপাতি ছিলেন। তাই তিনি শিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশের সঙ্গে সমতা রেখে রচনা করার কথা বলেছেন। তিনি মানসিক বৈশিষ্ট্যের তারতম্য অনুযায়ী শিশুর জীবনকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। শিশুর ৪ বছর বয়স থেকে ৮ বছর বয়স পর্যন্ত সময়কালকে তিনি বলেছেন - খেলা প্রাধান্য স্তর। এই সময় শিশুরা পরিবারের মধ্যে থেকে খেলার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে এবং ধীরে ধীরে তাদের এই সক্রিয়তা সামাজিক উপযোগিতামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়। শিশুর ৮ বছর থেকে ১২ বছর বয়স সীমাকে ডিউই নাম দিয়েছেন স্বতঃস্ফূর্ত মনোযোগের স্তর। এই সময় শিশু তার লক্ষ্য ও উপায়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে এবং তাদের মন প্রত্যক্ষ সমস্যা সমাধানের উপযোগী হয়ে ওঠে। শিশুর ১২ বছর বয়সের পরবর্তী জীবন কালকে ডিউই বলেছেন - মননশীল মনোযোগের স্তর। এই বয়সে শিশুরা নিজেরাই নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এবং সেগুলি তারা নিজেরাই সমাধান করতে পারে। সুতরাং শিশুর এই বৈশিষ্ট্য বিভাজন থেকে দেখা যাচ্ছে, তার প্রথাগত শিক্ষা মূলতঃ সমস্যার সমাধানের মধ্য দিয়ে হবে।
শিক্ষকের দায়িত্ব: শিক্ষকের দায়িত্ব সম্পর্কে ডিউই বলেছেন শিক্ষক শিক্ষার্থীর বন্ধু, সহায়ক এবং যোগ্য নির্দেশকের কাজ করেন। তার উপর কখনোই নিজের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করবেন না।
শিক্ষালয়ের ধারণা: শিক্ষালয় বা বিদ্যালয় সম্পর্কেও ডিউই এর ধারণার মধ্যে অভিনবত্ব ছিল। শিক্ষা তাঁর কাছে ছিল জীবন, শিক্ষা ছিল বিকাশ, শিক্ষা ছিল সমাজ উন্নয়নের প্রক্রিয়া। তিনি শিক্ষার ধারণার মধ্যে ব্যক্তিতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক মতবাদের সমন্বয় ঘটিয়ে ছিলেন। তাই তিনি মনে করতেন সামাজিক অগ্রগতির ধারা বজায় রাখতে হলে, শিক্ষার্থীদের সমাজ অনুরূপ পরিবেশেই সক্রিয় করে তুলতে হবে। তবেই তারা তাদের অভিজ্ঞতার পুনর্গঠনের মাধ্যমে সামাজিক অগ্রগতিতে সহায়তা করতে পারবে।
মন্তব্য: ডিউই এর শিক্ষা চিন্তার মধ্যে আমরা আর চিন্তাশীল মননের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রায় প্রত্যেকটি বৈশিষ্ট্যই তাঁর শিক্ষাচিন্তার মধ্যে বর্তমান। তাঁর প্রগতি ধর্মী শিক্ষা চিন্তা ও শিক্ষাদর্শ শিক্ষার সমস্ত দিকে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। ডিউইকে 'শিক্ষার আধুনিক ভাবধারার প্রতীক পুরুষ' বলা হয়ে থাকে।