উত্তর:
ভূমিকা: শিক্ষা জগতে এক অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হলেন মাদাম মারিয়া মন্তেসরী। পেশাগত দিক থেকে তিনি ছিলেন চিকিৎসক। তাঁর কর্মপ্রেরণার মূলে ছিল সেবামূলক মনোভাব। মানুষের সামগ্রিক মঙ্গল সাধনই ছিল তার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, মানুষের অজ্ঞতাই তার জীবনের সব রকম বিপর্যয়ের কারণ। তাই মানুষের সার্বিক উন্নতি করতে হলে তার উপযুক্ত শিক্ষার প্রয়োজন, এই ছিল তার জীবনের বিশ্বাস। জীবনের এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি জীবনের বেশি সময় শিশু শিক্ষার নীতি ও পদ্ধতি রচনায় ব্যয় করেন।
শিক্ষাক্ষেত্রে মন্তেসরী অবদান:
শিক্ষার লক্ষ্য: মন্তেসরী বিশ্বাস করতেন প্রত্যেক শিশুই তার একান্ত নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য ও ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। তাঁর মতে, শিশুর জন্মগত বৈশিষ্ট্য ও ক্ষমতাগুলি বিকাশ ধর্মী। প্রত্যেক শিশুই নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য অনুযায়ী অন্তর থেকে বিকাশ লাভ করবে। শিক্ষার লক্ষ্য হবে প্রত্যেক শিশুর আত্মবিকাশের প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করা। অর্থাৎ, মন্তেসরীর শিক্ষাচিন্তা অনুযায়ী, শিক্ষা হল বিকাশের প্রক্রিয়া আর তার লক্ষ্য হল ব্যক্তি জীবনের স্বাতন্ত্র্যের পরিচায়ক বিকাশ ঘটানো।
পাঠ্যক্রম: মন্তেসরী কেবল শিশুর শিক্ষার পাঠক্রম সম্পর্কে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। নিয়মমাফিক পাঠ্যক্রমে তিনি শিশুদের জন্য লেখা, পড়া এবং গণিত এই তিনটি বিষয় রাখার কথা বলেছেন। এছাড়া জীবনের পক্ষে প্রয়োজনীয় কতগুলি অভ্যাস এবং দক্ষতা বিকাশের উপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। কিভাবে নিজের দেহের যত্ন নিতে হয়, কিভাবে ঘর পরিষ্কার করতে হয়, কিভাবে পোশাক ইত্যাদি পরিষ্কার রাখতে হয়, সে সংক্রান্ত অভ্যাস ও দক্ষতা গঠনের কথা তিনি বলেছেন। এছাড়া শৈশবে দৈহিক বিকাশে সহায়তা করার জন্য তিনি বয়সোপযোগী কিছু ব্যায়ামের কথাও উল্লেখ করেছেন।
শিক্ষণ পদ্ধতি: মন্তেসরী প্রবর্তিত শিক্ষণ পদ্ধতি মন্তেসরী পদ্ধতি নামে পরিচিত। এই পদ্ধতি তিনটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রথমত: ইন্দ্রিয় পরিমার্জন আর নীতি; দ্বিতীয়তঃ সক্রিয়তার নীতি বা স্বয়ং শিক্ষার নীতি; এবং তৃতীয়তঃ স্বাধীনতার নীতি।
মন্তেসরী বলেছেন, শিশুদের মানসিক অগ্রসরতার জন্য দায়ী হলো তাদের ইন্দ্রিয়গুলি। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই আমরা বাইরের জগত থেকে জ্ঞান আহরণ করি। তাই শিশুকে সার্থকভাবে শিক্ষা দিতে হলে প্রথমেই তার ইন্দ্রিয়গুলিকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। এই নীতি কে বলা হয় ইন্দ্রিয় পরিমার্জনার নীতি। এই উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন ধরনের উপকরণ তৈরি করেন। এগুলিকে বলা হয় ডিড্যাকটিক এপারেটাস (Didactic Apparatus) এগুলির সহায়তায় শিশুরা সহজে বিভিন্ন উদ্দীপকের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে, প্রতিক্রিয়া করতে পারি। মন্তেসরী তার পূর্বসূরিদের মত শিখনের ক্ষেত্রে শিশুর আত্মসক্রিয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। শিক্ষার্থীরা নিজের চেষ্টায় যা শিখবে, উদ্ভাবিত ডিড্যাকটিক অ্যাপারেটাসগুলিতে তাই শিক্ষার্থীদের ত্রুটি দূর করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। এইভাবে আত্ম সক্রিয়তায় শেখার পদ্ধতিকে তিনি নাম দিয়েছেন স্বয়ং শিখন। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের স্বয়ং শিখনের সুযোগ দিতে হলে স্বাধীনতার প্রয়োজন। তাই মন্তেসরী স্বাধীনতাকে শিক্ষার যোগ্য মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
মন্তেসরী শিক্ষণ পদ্ধতি সাধারণভাবে ছয় বছর পর্যন্ত শিশুদের শিক্ষার জন্য রচিত হয়েছিল। এই পদ্ধতিতে পাঠ্যক্রমে তিন দিক থেকে অনুশীলনের ব্যবস্থা আছে।
প্রথমত: শিশুদের জীবন যাপনের উপযোগী শিক্ষা দেওয়ার জন্য কাপড় কাচা, নখ কাটা, দাঁত মাজা, ঘর পরিষ্কার করা ইত্যাদির মত কাজ শেখানো হয়। এই ধরনের কাজের মধ্য দিয়ে একদিকে তাদের দৈহিক বিকাশে সহায়তা করা হয়, আবার অন্যদিকে তারা জীবনের প্রত্যক্ষ কার্যাবলীর সঙ্গে পরিচিত হয়।
দ্বিতীয়তঃ মন্তেসরী তার পদ্ধতিতে ডিড্যাকটিক অ্যাপারেটাস এর সাহায্যে শিশুদের ইন্দ্রিয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। যেমন বিভিন্ন আকারের কাঠের টুকরো, কাগজ, আসবাবপত্র, বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা, পেন্সিল, বিভিন্ন রঙের উল, বাক্স, ঘণ্টা, ঘনক ইত্যাদি এইসব বস্তু-সামগ্রীর মাধ্যমে শিশুদের আকার, আয়তন, রং, ওজন ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়ে থাকে।
তৃতীয়তঃ প্রথাগত লেখা, পড়া ও গণিত শিক্ষাদানের বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থা এই পদ্ধতির মধ্যে আছে।
শিক্ষকের ধারণা: মন্তেসরী পদ্ধতিতে শিশুকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয় এবং তাদের স্বয়ং শিখনের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাই এই পদ্ধতিতে শিক্ষিকার ভূমিকাও বিশেষ ধরনের। তার প্রধান দায়িত্ব হল শিশুর শিখন প্রচেষ্টাকে নির্ধারিত পথে পরিচালনা করা। মন্তেসরী তার এই শিক্ষিকা বা পরিচালিকার প্রয়োজনীয় গুণাবলী সম্পর্কে বলেছেন - " Virtues and not words are the main qualifications of the teacher. She should be partly a scientist, partly a doctor and completely religious." অর্থাৎ শিশুদের সামগ্রিক দিক থেকে সাহায্য করার জন্য সামগ্রিক দিক থেকে সাহায্য করার জন্য যত রকমের মানবিক গুণ থাকা প্রয়োজন, তা শিক্ষিকার থাকা উচিৎ।
মন্তব্য: মন্তেসরীর শিক্ষা চিন্তা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে নানা দিক থেকে প্রভাবিত করেছে। বিশেষভাবে তাঁর প্রবর্তিত পদ্ধতি আধুনিককালে শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে এক স্থায়ী আসন অধিকার করেছে। তবে তার শিক্ষাচিন্তার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান হলো ব্যক্তি কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন। তিনি বলেছেন প্রত্যেক শিশুকে পৃথকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং প্রয়োজনবোধে পৃথকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করতে হবে। এই কারণে অনেকে মনে করেন মন্তেসরী শ্রেণী শিক্ষণ ব্যবস্থার মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়েছেন।