মেকলে মিনিট: 1813 সালের সনদ আইনের শিক্ষা সংক্রান্ত 43 নং ধারার ব্যাখ্যা নিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বাদীদের মধ্যে বিরোধ চরম অবস্থায় পৌঁছায়। এই বিরোধের অবসান ঘটাতে শিক্ষা কমিটি (জি সি পি আই) এর সদস্যরা কোম্পানির দ্বারস্থ হন। এমত অবস্থায় 1834 সালে লর্ড মেকলে বড়লাটের পরিষদে আইন সদস্যরূপে যোগ দেন। বড়লাট লর্ড বেন্টিন্ক তাকে শিক্ষা কমিটির সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত করেন। শিক্ষা কমিটির সভায় কিন্তু মেকলে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিরোধে অংশগ্রহণ করেননি। তাই কমিটি যখন সনদ আইন এর ব্যাখ্যা সরকারের কাছে চাইল, তখন বড়লাট বেন্টিন্ক সে বিষয়ে আইনগত মতামত দেওয়ার জন্য সেটিকে মেকলের কাছে পাঠালেন। মেকলে এ বিষয়ে অভিমত দেন 1835 সালের 2রা ফেব্রুয়ারি। 1813 সালের সনদ আইনের শিক্ষা ধারা সংক্রান্ত মেকলে প্রদত্ত এই ব্যাখ্যা মেকলে মিনিট নামে খ্যাত।
মেকলের বিবরণীর প্রধান বক্তব্যসমূহ: মেকলের বিবরণীর প্রধান বক্তব্য গুলি ছিল -
১) ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দিতে হবে।
২) পুরানো অকেজো দেশীয় বিদ্যালয়গুলি বন্ধ করে দিতে হবে।
৩) নতুন যুগের নতুন শিক্ষার উপযুক্ত স্কুল কলেজ খুলতে হবে।
মেকলে মিনিটের ব্যাখ্যা: 1813 সালের সনদ আইন এর 43 নং ধারাযর ব্যাখ্যায় লর্ড মেকলে যে মন্তব্য করেছিলেন তা হল -
১) মেকলের মতে, সাহিত্য বলতে শুধুমাত্র সংস্কৃত বা আরবি সাহিত্যকে বোঝায় না; ইংরাজি সাহিত্যকেও বোঝায়।
২) শিক্ষিত ভারতীয় বলতে সংস্কৃত পণ্ডিত বা আরবি ফার্সিতে পারদর্শী মৌলবীকে বোঝায় না। যারা লকের দর্শন বা মিল্টনের কবিতায় পারদর্শিতা লাভ করেছেন তাদেরও বোঝায়।
৩) বিজ্ঞান শিক্ষার প্রবর্তন ও প্রসার বলতে তিনি ইংরেজি শিক্ষার প্রসার বলে উল্লেখ করেন। এই কারণে মেকলের মতে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সরকার ভালো মনে করবেন তাই প্রচার করার কথাই বলা হয়েছে।
৪) প্রাচীন ভারতীয় ভাষা সম্পর্কে তিনি বলেন, এই ভাষাগুলি ইউরোপীয় ভাষাগুলির তুলনায় অনেক নিকৃষ্ট ও ভুলে ভরা। এবং পরিশেষে তিনি বলেন, ইংরেজির মত সম্পদশালী ভাষায় শিক্ষার সুযোগ যেখানে রয়েছে সেখানে অন্য ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার অর্থ নেই। অর্থাৎ তিনি ইংরেজিকেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করার কথা বলেছেন।
ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করার স্বপক্ষে যুক্তি: মেকলে ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করার স্বপক্ষে যে যুক্তিগুলো দেখেছিলেন সেগুলি হল -
১) ইংরেজি ভাষা পাশ্চাত্য ভাষা সমূহের মধ্যে প্রধান।
২) গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষা যেমন ইংরেজি ভাষার সমৃদ্ধির মূলে ছিল তেমনি ইংরেজি ভাষা ভারতীয় ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে পারবে।
৩) ইংরেজি ভাষা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চাবিকাঠি।
৪) ইংরেজি শাসকশ্রেণীর ভাষা, ইংরেজি ভাষা না শিখলে ভারতবাসীর সরকারি কাজকর্মে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
৫) এই ভাষার মাধ্যমে পশ্চিমী দেশীয় সভ্যতার নামে ভারতবাসীরা ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে উঠবে।
৬) মেকলে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ব্যাপারে পরিশ্রুত মতবাদে (Downward Filtration Theory) বা চুঁইয়ে পড়া নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে যেসব ভারতবাসী উচ্চশিক্ষা লাভ করবেন তারা পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান এর মর্ম উপলব্ধি করে নিজেদের দায়িত্বেই অন্যান্য ভারতবাসীর শিক্ষা পরিচালনায় অংশগ্রহণ করবেন।
৭) ইংরেজি শিক্ষার ফলে এ দেশে এমন এক শ্রেণীর লোক সৃষ্টি হয়ে হবে যারা বর্ণে ও রক্তেই শুধু ভারতীয় থাকবে, কিন্তু মতামত, নীতি ও বুদ্ধিতে হবে ইংরেজ।
মেকলে মিনিটের সমালোচনা: ইংরেজি শিক্ষা সম্পর্কে বিখ্যাত মেকলেথ মিনিট দেশী, বিদেশী সকলের কাছ থেকে সমভাবে প্রশংসা লাভ করলেও অনেকেই তার সমালোচনা করেছেন। ভারতীয় ভাষাসমূহের উন্নতির সম্ভাবনাকে নষ্ট করেছেন বলে তারা দাবি করেছেন সমালোচনার দিক গুলি হল -
১) ভারতীয় ভাষা, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন সম্পর্কে মেকলে তাঁর বিবরণীতে যে অপমান করেছেন তার জন্য অনেকেই তাঁর শুধু নিন্দায় করেননি, তাঁকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক অসন্তোষের কারণ হিসেবে দায়ীও করেছেন।
২) ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম করে তিনি ভারতে নিরক্ষরতার পথ প্রশস্ত করেছিলেন। লর্ড কার্জন এর মত আরো ইংরেজ শাসকগণ বলেছিলেন যে, ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম করার ফলে ভারতে জনশিক্ষার গতি অত্যন্ত পিছিয়ে গেছে।
৩) তিনি শিক্ষা ক্ষেত্রে চুঁইয়ে পড়া নীতি অনুসরণ করে উচ্চ মধ্যবিত্তদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, জনশিক্ষার নয়।
৪) মেকলের কাছে শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের ইংরেজ প্রভুদের প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষিত করা।
৫) মেকলে তাঁর শিক্ষা সংক্রান্ত এই মতামতের জন্য ঐতিহাসিকদের দ্বারা সমভাবে নিন্দিত ও প্রশংসিত হয়েছিলেন। অনেকে তাঁকে আধুনিক ভারতীয় শিক্ষার জনক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কারণ, তারা মনে করেন, মেকলে ভারতে পাশ্চাত্য জ্ঞানের আমদানিতে সহায়তা করেছিলেন এবং শিক্ষা সংক্রান্ত পরবর্তী সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করেছিলেন।