Tuesday, 7 April 2020

ভারতীয় বিচারব্যবস্থা বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর

ভারতীয় বিচারব্যবস্থা বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১) ভারতীয় বিচারব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী?
উত্তর : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান মাধ্যম হল বিচার বিভাগ। তাই ভারতের সংবিধান রচয়িতাগণ প্রচলিত গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী বিচার বিভাগের ভূমিকা স্থির করেন। ভারতীয় বিচারব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
(এক) ভারতের যুক্তরাষ্টীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হলেও এখানে দ্বৈত বিচারব্যবস্থার পরিবর্তে অখণ্ড বিচারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে।
(দুই) ভারতবর্ষের সর্বত্র একই দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিধি প্রচলিত আছে।
(তিন) নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব বর্তায় হাইকোর্ট এবং সুপ্রিমকোর্টের উপর।
(চার) যে সমস্ত দরিদ্র ব্যক্তির বার্ষিক আয় ৫০০০০ টাকার কম তাদের কোনাে মামলা থাকলে সরকার কর্তৃক আইনগত সাহায্য দানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
(পাঁচ) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বিচার বিভাগকে শাসন ও আইন বিভাগের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে। এছাড়াও এমন কতকগুলি বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলির দ্বারা বিচার বিভাগের ত্রুটিই প্রকাশ পায়। যেমন—আইনের দৃষ্টিতে অসাম্য, দীর্ঘসূত্রিতা, ব্যয়বহুল শাসন বিভাগ কর্তৃক বিচারপতি নিয়ােগ এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের অনুপস্থিতি ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যায়।
প্রশ্ন ২) ভারতের সুপ্রিমকোর্টের স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য সংবিধানে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে?
উত্তর : ভারতের সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের স্বাধীনভাবে কাজ করার উপর নির্ভর করছে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা। এই উদ্দেশ্যটিকে সফল করার জন্য সংবিধানে কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যথা—
(এক) বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার জন্য গুণগত যােগ্যতাকেই প্রধান মাপকাঠি হিসাবে রাখা হয়েছে।
(দুই) শুধুমাত্র অসদাচরণ অথবা অক্ষমতা ছাড়া অপর কোনাে কারণে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ করা যায় না।
(তিন) সংসদে বিচারপতিদের রায়ের যৌক্তিকতা নিয়ে কোনাে প্রশ্ন তােলা যাবে না।
(চার) সুপ্রিমকোর্টের কোনাে বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর ভারতের কোনাে আদালতে আইনজীবী হিসাবে কাজ করতে পারবে না।
(পাঁচ) বিচারপতি থাকাকালে তাদের বেতন, ভাতা ইত্যাদি কমানাে যায় না।
(ছয়) সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের বেতন, ভাতা বাবদ যে খরচ হবে তা ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে নির্বাহ করা হবে।
প্রশ্ন ৩) ভারতের সুপ্রিমকোর্টের আপিল এলাকা সংক্রান্ত ক্ষমতাগুলি সংক্ষেপে আলােচনা করাে।
উত্তর : ভারতের সর্বোচ্চ আপিল আদালত হল সুপ্রিমকোর্ট। এর আপিল এলাকাকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
(ক) সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত আপিল : ভারতীয় সংবিধানের ১৩২ নং ধারা অনুযায়ী কোনাে দেওয়ানি, ফৌজদারি বা অন্য যে-কোনাে মামলার বিষয়ে হাইকোর্ট যদি সার্টিফিকেট দেয় যে, সংশ্লিষ্ট মামলাটির সঙ্গে সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত আছে, তাহলে তা সুপ্রিমকোটে আপিল করা যাবে।
(খ) দেওয়ানি আপিল : সংবিধানের ১৩৩ নং ধারা অনুসারে কোনাে দেওয়ানি মামলার সঙ্গে আইনের গুরত্বপূর্ণ যে-কোনাে প্রশ্ন জড়িত আছে অথবা হাইকোর্ট যদি মনে করে যে কোনাে দেওয়ানি মামলার বিচার সুপ্রিমকোর্টে হওয়া উচিত তাহলে সেই মামলার বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যাবে।
(গ) ফৌজদারি আপিল : সংবিধানের ১৩৪ নং ধারা অনুসারে ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে-
(অ) নিম্ন আদালতে নির্দোষ বলে প্রমাণিত কোনাে ব্যক্তিকে হাইকোর্ট যদি মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘােষণা করে,
(আ) হাইকোর্ট নিম্নতর আদালত থেকে কোনাে মামলা নিজের হাতে তুলে নিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রাণদণ্ড দিলে,
(ই) মামলাটি সুপ্রিমকোর্টে আবেদনযােগ্য—এই মর্মে হাইকোর্ট সার্টিফিকেট দিলে ইত্যাদি বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায়।
(ঘ) বিশেষ অনুমতি সূত্রে আপিল ও সংবিধানের ১৩৬ নং ধারা অনুসারে সুপ্রিমকোর্ট ভারতের যে-কোনাে আদালতের যে-কোনাে রায়, আদেশ বা ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য ‘বিশেষ অনুমতি’ (Special Leave) দিতে পারে। তবে সামরিক আদালত বা ট্রাইবিউনলের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টের এই ক্ষমতা নেই।
প্রশ্ন ৪) ভারতীয় সংবিধানের অভিভাবক এবং ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা কী তা সংক্ষেপে উল্লেখ করাে।
উত্তর : ভারতীয় সংবিধানের অভিভাবক এবং চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকর্তা হল ভারতের সুপ্রিমকোর্ট। সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের কোনাে অংশের বিশ্লেষণ যেভাবে দেয় সেই ভাবেই তার অর্থ নির্ধারিত হয়। ভারতের কোনাে বিচারালয়—এমনকি পার্লামেন্টও সেই বিশ্লেষণকে উপেক্ষা করতে পারে না। আইনের বৈধতা বিচারের ক্ষমতার সাহায্যে সুপ্রিমকোর্ট এই রকম ভূমিকা পালন করে থাকে। তা ছাড়া সংবিধান দেশের মৌলিক আইন হওয়ায় এর বিরােধী যে-কোনাে আইন ও সরকারি সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিকতার দায়ে সুপ্রিমকোর্ট বাতিল করে দিতে পারে। তবে ভারতের সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, এটি মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের মতাে যেমন শক্তিশালী নয়, আবার গ্রেট ব্রিটেনের আদালতের মতাে দুর্বলও নয়। অর্থাৎ ব্রিটেনে পার্লামেন্টের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট প্রণীত সকল আইনই আদালতের কাছে বৈধ। এখানে আদালত আইন ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু বৈধতা বিচার করতে পারে না। অপরদিকে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট যে-কোনাে আইন বিধিসম্মত পদ্ধতি অনুসারে প্রণীত হয়েছে কি না তা যেমন বিচার করে দেখে, সেই সঙ্গে আহনটি স্বাভাবিক ন্যায়নীতিবােধের বিরােধী কি না তাও বিচার করে দেখে। মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট যে-কোনো অযৌক্তিক আইনকে বাতিল করে দিতে পারে। ভারতের সুপ্রিমকোর্টের এ ক্ষমতা নেই। এখানে সুপ্রিমকোর্ট দেখে যে, আইনটি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যথাযথ পদ্ধতি অনুসারে প্রণীত হয়েছে। ভারতের সুপ্রিমকোর্ট আইনের গুণাগুণ বিচার করতে পারে না। শুধু তাই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের মতাে ভারতীয় সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় নয় বলে পার্লামেন্ট সংবিধান সংশােধন করে খুব সহজেই সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ অথবা রায়কে অকেজো করে দিতে পারে। তাই বর্তমানে ভারতীয় সংবিধানের অভিভাবক এবং ব্যাখ্যাকর্তা হিসাবে সুপ্রিমকোর্ট তার ভূমিকা পালন করতে পারে সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসার চিহ্ন থেকেই যায়।
প্রশ্ন ৫) ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা কী?
উত্তর : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হল নাগরিকদের লিখিত মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ। ভারতের ন্যায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই অধিকারগুলিকে সযত্নে সংরক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে সুপ্রিমকোর্টের উপর। তাই সুপ্রিমকোর্ট মৌলিক অধিকার বিরােধী যে-কোনাে আইন বা সরকারি নির্দেশ অসাংবিধানিকতার দায়ে বাতিল করে দিতে পারে। সংবিধানের ১৩ নং ধারায় মৌলিক অধিকারগুলিকে আইনসভার স্বেচ্ছাচারিতার হাত থেকে যথাযথভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া ভারতীয় সংবিধানে সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার লিপিবদ্ধ হওয়ায় মৌলিক অধিকার রক্ষার প্রাথমিক এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সুপ্রিমকোর্টের উপর বর্তায়। সুপ্রিমকোর্ট এই দায়িত্ব পালনে পাঁচ ধরনের, যথা বন্দি-প্রত্যক্ষীকরণ, পরমাদেশ, প্রতিষেধ, অধিকার পৃচ্ছা এবং উৎপ্রেষণ ইত্যাদি লেখ (Writ) জারি করে, সুতরাং বলা যায় যে, নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের রক্ষক এবং অভিভাবক হিসাবে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। তবে দেশে জরুরি অবস্থা জারি ঘােষণা করে এবং পার্লামেন্টে সংবিধান সংশােধন করে খুব সহজেই মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করা যায়। মৌলিক অধিকার রক্ষায় সুপ্রিমকোর্ট কতটা কার্যকারী ভূমিকা পালন করতে পারবে—তা ভবিষ্যৎ সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিই দিক নির্দেশ করে দেবে।
প্রশ্ন ৬) ভারতের যে-কোনাে অঙ্গরাজ্যের হাইকোর্টের মূল এলাকাভুক্ত ক্ষমতাগুলি কী কী তা উল্লেখ করাে।
উত্তর : ভারতীয় সংবিধানের ২১৫ নং ধারা অনুসারে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে একটি করে হাইকোর্ট থাকবে। আবার এক বা একাধিক অঙ্গরাজ্যের জন্য একটি করে হাইকোর্ট থাকতে পারে। অঙ্গরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত হিসাবে হাইকোর্টকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। মূল এলাকাভুক্ত ক্ষমতা হল হাইকোর্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা। মূল এলাকার অর্থ হল সরাসরি মামলা দায়ের করার ক্ষমতা। রাজস্ব সংক্রান্ত সমস্ত বিরােধ নিষ্পত্তির বিষয়ই হাইকোর্টের মূল এলাকাভুক্ত বিষয়ের মধ্যে পড়ে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ৪২তম সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে হাইকোর্টের এই এলাকা সংক্রান্ত ক্ষমতা বিলােপ করা হয়। কিন্তু ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ৪৪তম সংবিধান সংশােধন করে এই ক্ষমতা হাইকোর্টকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ফৌজদারি দণ্ডবিধি আইন অনুযায়ী ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তি হাইকোর্টের মূল এলাকাভুক্ত ক্ষমতা থেকে বিলােপসাধন করে কলকাতা, মুম্বই এবং চেন্নাই শহরে তা নগর দায়রা আদালতে সম্পাদন করা হয়।
প্রশ্ন ৭) ভারতের লােকআদালত সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত টীকা রচনা করাে।
উত্তর : ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যে দরিদ্র এবং দুর্বল ভারতবাসী যাতে সহজে যথাযথ ন্যায়বিচার লাভ করতে পারে তার জন্য ১৯৮৭ সালে ‘আইনগত পরিসেবা কর্তৃপক্ষ নামে’ একটি আইন প্রণয়ন করে সংসদ লােকআদালতকে আইনগত স্বীকৃতি দিয়েছে। বিচারপতি পি.এন ভগবতী ‘লােকআদালত’ গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। লােকআদালত গঠিত হয় একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচার বিভাগীয় আধিকারিক, একজন বিখ্যাত আইনজীবী এবং একজন সমাজসেবী নিয়ে। লােকআদালতের এক্তিয়ারে ফৌজদারি এবং দেওয়ানি যে-কোনাে মামলার নিষ্পত্তি হতে পারে। আদালতে অনেকদিন ঝুলে আছে কিংবা যে-কোনাে বিষয় যা কোনাে আদালতে উত্থাপিত হয়নি তার বিচার লােকআদালত করতে পারে। এই আদালতে যেহেতু বাদী এবং বিবাদী উভয়পক্ষের সহমতের ভিত্তিতে বিচারকার্য সম্পাদন হয় বলে উভয়পক্ষই এই আদালতের রায় মেনে নিতে বাধ্য। লােকআদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কোথাও আপিল করা যায় না। লােকআদালতের এক্তিয়ারকে সম্প্রসারিত করার ফলে পরিবহন, ডাক, যােগাযােগ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, হাসপাতাল, বিমা এবং বিবাহ ইত্যাদি বিষয়ের মামলা নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে লােকআদালত উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। লােকআদালতে কোনােরকম খরচ হয় না বলে এবং দ্রুত বিরােধের মীমাংসা করা যায়
বলে এর জনপ্রিয়তা উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
Comment

Class XI Political Science

Class XII Political Science

Class 12 Bangla Books Question& Answers