হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের পর ভারতে যে সভ্যতার উন্মেষ হয় তার নাম বৈদিক সভ্যতা।
বেদকে ভিত্তি করে এই সভ্যতা গড়ে ওঠে বলে এর নাম বৈদিক সভ্যতা।
এই সভ্যতার স্রষ্টা ছিল আর্য। খাঁটি সংস্কৃত শব্দে আর্য কথার অর্থ হলো সৎবংশজাত বা অভিজাত মানুষ। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা র মধ্যে সংস্কৃত,ল্যাটিন, গথিক,কেলটিক,পারসিক প্রভৃতির মধ্যে যারা একটি ভাষায় কথা বলতেন তারাই হলো আর্য।
আর্য দের আদি বাসস্থান কোথায় ছিল সে সম্পর্কে পন্ডিতরা একমত নন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক ভারত কে,কোনো কোনো ঐতিহাসিক ইউরোপ কে,তো কোনো কোনো ঐতিহাসিক আবার মধ্য এশিয়া কে আর্য দের আদি বাসস্থান বলে বর্ণনা করেন। তবে বিশিষ্ট প্রাচ্য বিদ্যা- বিশারদ ব্রান্ডেনস্টাইন প্রাচীন আর্য ভাষাতত্ত্ব ও শব্দার্থ বিদ্যার উপর গবেষনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে উরাল পর্বতের দক্ষ্মিণে অবস্থিত কিরঘিজ তৃণভূমি ছিল আর্য দের আদি বাসভূমি।
খাদ্যাভাব, স্থানাভাব, গৃহবিবাদ প্রভৃতি নানা কারণে আর্য রা তাদের আদি বাসভূমি ত্যাগ করে এশিয়া ইউরোপের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের একটি শাখা ভারতে প্রবেশ করে। তবে কবে তারা ভারতে প্রবেশ করলো তা নির্ণয় করা খুবই দুরূহ কারণ এই বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য আবিস্কৃত হয়নি।
ঋগ্বেদ হল আর্য দের প্রাচীনতম গ্রন্থ। ঋগ্বেদের রচনা কাল জানলে আর্য দের আগমনের সময় সম্পর্কে একটি ধারণা করা যাবে। প্রথমে ঋগ্বেদের স্তোত্রগুলি রচিত হলেও তা লিপিবদ্ধ করা হত় না— কানে শুনে বা শ্রুতির মাধ্যমে বংশ পরম্পরায় তা চলে আসত।
দীর্ঘদিন নিজ ভূমিতে বসবাসের পর আর্যরা বহির্দেশ গমন করে। তাদের সমষ্টিগত দেশ ত্যাগের কোনও সুস্পষ্ট কারণ জানা যায় না। তবে মনে করা হয় যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খাদ্যাভাব,ভূমির অভাব,জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জমির শুস্কতা বৃদ্ধি, গৃহবিবাদ প্রভৃতি কারণেই তারা দেশে ত্যাগে বাধ্য হয়।
W. Durant বলেন যে, তারা জাতীয় সম্মানের জন্য যুদ্ধ করত না, গবাদি পশু সংগ্রহে র জন্যই যুদ্ধ করত।
তাদের একটি অংশ অগ্রসর হয় পশ্চিম ইউরোপের দিকে, অপর অংশটি অগ্রসর হয় পূর্বদিকে। যে অংশ টি পূর্বদিকে অগ্রসর হয়, তারা প্রথমে পারস্যে বসতি স্থাপন করে। তারপর পারস্য থেকে তাদের একটি অংশ চলে যায় ভারতে।
ভারতে প্রবেশকালে আর্য রা কয়েকটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। এই গোষ্ঠী গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সৃঞ্জয়, অনু, পুরু, ভরত, যদু, দ্রুহু, তুর্বস।
গরু চুরি, জমি দখল ও নদীর জলের উপর কর্তৃত্ব নিয়ে সর্বদাই তাদের মধ্যে বিরোধ চলতো। এছাড়া স্থানীয় দ্রাবিড়- ভাষী অনার্য দের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ জয় করেও তাদের এই অঞ্চলে বসতি বিস্তার করতে হয়। এই সময় ভরত গোষ্ঠী খুব উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে।
ঋকবেদে দশ রাজার যুদ্ধের কথা উল্লেখ আছে। আর্যদের দশটি গোষ্ঠী ভরত গোষ্ঠীর রাজা সুদাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
এই যুদ্ধে জয়যুক্ত হয়ে রাজা সুদাস ভরত গোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ গৌরবের ভিত্তি স্থাপন করেন। বলা হয় ভরত গোষ্ঠীর নাম থেকেই আমাদের দেশের নাম হয় ভারতবর্ষ।
পন্ডিতরা বৈদিক যুগকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন, ঋক বৈদিক যুগ এবং পরবর্তী বৈদিক যুগ। ঋক বৈদিক যুগের সময়কাল ধরা হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্ব।
ঋক বৈদিক যুগের প্রধান উপাদান হলো ঋকবেদ।
ঋকবৈদিক যুগে পরিবার ছিল সমাজের সর্বনিম্ন স্তর। এই পরিবার ই ছিল রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি। কয়েকটি পরিবার নিয়ে গঠিত হতো clan বা গোষ্ঠী। কয়েকটি clan নিয়ে গঠিত হত ট্রাইৰ বা উপজাতি। ঋকবৈদিক যুগে এই ট্রাইৰ বা উপজাতি ই হলো সর্বোচ্চ রাজনৈতিক স্তর বা রাষ্ট্র।
অন্য ভাবে বলা যায় যে,এই যুগে আর্যদের রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল উপজাতিকেন্দ্রিক।
এই যুগে আর্য ও অনার্যদের মধ্যে যেমন সংঘর্ষ চলতো তেমনি ভূমি ও গোসম্পদের দখল নিয়েও বিভিন্ন আর্য গোষ্ঠীগুলির মধ্যে অবিরাম সংঘর্ষ চলত। এককথায় সামগ্রিক পরিস্থিতি ছিল বিশৃঙ্খলাপূর্ণ।
তাই এই অবস্থার অবসান ঘটানো বা যুদ্ধজয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন যোগ্যতাসম্পন্ন ও শক্তিশালী নেতার প্রয়োজন দেখা দেয়। এইভাবেই সমাজে রাজতন্ত্রের উৎপত্তি ঘটে।
ঋকবেদে কিছু শাসনতান্ত্রিক বিভাগের উল্লেখ আছে যথা গ্রাম, বিশ, জন।
পরিবার ছিল এই যুগের রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি এবং সর্বনিম্ন রাজনৈতিক স্তর। পরিবারকে বলা হতো কুল এবং এই কুলের প্রধান বা পরিবারের প্রাচীনতম পুরুষটিকে বলা হতো কুলপ।
কয়েকটি পরিবার নিয়ে গঠিত হতো গ্রাম এবং গ্রামের প্রধান কে বলা হতো গ্রামনী। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত হতো বিশ এবং তার প্রধান কে বলা হতো বিশপতি। জন এর প্রধান কে বলা হতো গোপ।
জন ও বিশ এর মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করা দুরূহ—- তবে মনে করা হয় যে,জন হলো বিশ এর চেয়ে বড় শাসনতান্ত্রিক স্তর এবং তা একটি রাষ্ট্রের সমকক্ষ।
রাজতন্ত্রই ছিল সাধারণভাবে প্রচলিত শাসন- ব্যবস্থা এবং রাজাকে বলা হতো রাজন।
রাজতন্ত্র সাধারণত বংশানুক্রমিক ছিল,তবে প্রয়োজনে জনসাধারণ বা বিশ রাজা মনোনয়ন করতে পারতো। রাজতন্ত্র এর পাশাপাশি কিছু আরাজতন্ত্রী রাজ্যও ছিল।
ঋকবেদে গণ বা প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উল্লেখ আছে।এর শাসকদের গণপতি বা জ্যেষ্ঠ বলা হত। আবার কোনো কোনো গোষ্ঠীর মুষ্টিমেয় নেতা যৌথভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন এবং তারা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হতেন।এগুলিকে অভিজাততন্ত্র বা মুষ্টিমেয়তন্ত্র বলা হত।
ঋগবেদে রাজা সর্বশক্তিমান হলেও কখনোই স্বৈরাচারী ছিলেন না।তাকে সব বিষয়েই সভা ও সমিতি নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের মত নিয়ে চলতে হতো।
রাজাকে শাসনকার্য সহায়তা করতেন পুরোহিত, সেনানী, ব্রজপতি, গ্রমনী,গুপ্তচর, দূত প্রভৃতি কর্মচারীরা। মেয়েদের যুদ্ধে অংশ নেওয়ার কথা ও উল্লেখ আছে।
এই যুগে কোনো নিয়মিত কর ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
তবে বিচারব্যবস্থা ছিল খুব কঠোর।রক্তপাত জনিত অপরাধের শাস্তি ছিল শতদায় বা একশত গরু।
পরবর্তী বৈদিক যুগ
ঋক-বৈদিক যুগের পর থেকে বুদ্ধদেবের আগমনের পূর্ববর্তী যুগ পর্যন্ত সময়কে পরবর্তী বৈদিক যুগ বলা হয়।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের স্থলে এই যুগে বৃহৎ বৃহৎ রাজ্যের উৎপত্তি পরিলক্ষিত হয়। রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শাসনকার্য এ জটিলতা বৃদ্ধি পায়।
এই সময় বলি ও শুল্ক নামে দুই ধরনের রাজস্ব ও আদায় করা হতো। ব্রাহ্মণ বা রাজপরিবারের সদস্যদের কোনও রাজস্ব দিতে হতো না। জনসাধারণ ই তা বহন করত।
খ্রিস্ট -পূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতে কোনো কেন্দ্রীয় রাজশক্তি ছিল না এবং এই যুগে কোনো অখণ্ড সর্ব ভারতীয় রাজ্যও গড়ে ওঠে নি।
Short Question-Answer on Vedic Civilization (বৈদিক সভ্যতা)
আর্যদের প্রধান ধর্মগ্রন্থের নাম কী ? উঃ আর্যদের প্রধান ধর্মগ্রন্থের নাম বেদ।
ব্রহ্মবাদিনী কাদের বলা হয় ? উঃ যে সমস্ত নারী ধর্মচর্চা করে জীবন অতিবাহিত করেন তাদের ব্রক্ষ্মবাদিনী বলা হয়।
‘বেদ’কে অপৌরুষেয় বলা হয় কেন ? উঃ আর্যদের বিশ্বাস ছিল যে বেদ কোনাে মানুষের দ্বারা সৃষ্টি হয়নি। বলা হয়ে থাকে যে, বেদ ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত বাণী, সেইজন্য বেদকে অপৌরুষেয় বলা হয়।
আর্যরা ভারতে কোথায় প্রথমে বসতি স্থাপন করে ? উঃ আর্যরা ভারতে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে প্রথমে বসতি স্থাপন করে।
কোন অঞ্চলকে ‘সপ্তসিন্ধু’ অঞল বলা হত ? উঃ আফগানিস্তান থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলকে সপ্তসিন্ধু (ঝিলম, বিতস্তা, চন্দ্রভাগা, ইরাবতী, বিপাশা, শতদ্রু ও সিন্ধু) অঞ্চল বলা হত।
বৈদিক সভ্যতা কী ? উঃ বেদকে ভিত্তি করে যে সভ্যতা গড়ে ওঠে তাই বৈদিক সভ্যতা।
‘আর্য’ কথাটির অর্থ কী? উঃ খাঁটি সংস্কৃত ভাষায় ‘আর্য’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল সদবংশজাত বা অভিজাত মানুষ। আর্য বলতে অনেকে একটি জাতি বােঝেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আর্য কোনাে জাতি নয়। এটি হল একটি ভাষাগত ধারণা।
কারা ভারতবর্ষে লৌহযুগের সূচনা করেন? উঃ আর্যরা ভারতবর্ষে লৌহযুগের সূচনা করেন।
ভারতের প্রাচীন নাম কী ? উঃ ভারতের প্রাচীন নাম জম্বুদ্বীপ।
চারটি বেদের নাম কী ? উঃ চারটি বেদের নাম ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব।
ভারতের প্রাচীনতম সাহিত্য কোনটি ? উঃ ভারতের প্রাচীনতম সাহিত্য হল ঋগ্বেদ।
‘বেদ’ কথাটির উৎপত্তি কীভাবে হয় ? উঃ ‘বেদ’ কথাটির উৎপত্তি ‘বিদ’ শব্দ থেকে। এর অর্থ ‘জ্ঞান।
প্রত্যেক বেদের কটি অংশ ও কী কী ?উঃ প্রত্যেক বেদের চারটি অংশ, যথা—সংহিতা, ব্রাহ্ণ, আরণ্যক ও উপনিষদ বা বেদান্ত।
বেদের শেষ অংশের নাম কী ?উঃ বেদের শেষ অংশের নাম ‘উপনিষদ’ বা ‘বেদান্ত’।
আর্যদের আদি বাসভূমি কোথায়?উঃ আর্যদের আদি বাসভূমি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তার মধ্যে ম্যাক্সমুলার প্রমুখ পণ্ডিতগণের মতে আর্যদের আদি বাসস্থান হল মধ্য এশিয়া।
বৈদিক সমাজে গ্রামের প্রধানকে কী বলা হত ?উঃ বৈদিক যুগে গ্রামের প্রধানকে ‘গ্রামণী’ বলা হত।
বৈদিক যুগে ‘অক্ষবাপ’ কাকে বলা হত ?উঃ বৈদিক যুগে ন্যূতক্রীড়ার প্রধানকে ‘অক্ষবাপ’ বলা হত।
বৈদিক যুগে প্রচলিত স্বর্ণমুদ্রা দুটির নাম কী ?উঃ বৈদিক যুগে প্রচলিত দুটি স্বর্ণমুদ্রা হল ‘নিষ্ক’ এবং ‘মনা’।
আর্যদের প্রাচীনতম গ্রন্থ কোনটি ?উঃ ঋগবেদ আর্যদের প্রাচীনতম গ্রন্থ।
আর্যদের ‘চতুরাশ্রমের’ প্রথম আশ্রমের নাম কী ?উঃ আর্যদের চতুরাশ্রমের প্রথম আশ্রমের নাম ব্ৰত্মচর্য।
বেদকে শ্রুতি বলা হয় কেন?উঃ ‘বেদ’ আর্য ঋষিদের বাণী এবং কানে শােনা এইসব বেদের বাণী মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে বলে বেদকে শ্রুতি বলা হয়।
মৈত্রেয়ী কে ছিলেন ?উঃ মৈত্রেয়ী ছিলেন বৈদিক যুগের একজন বিদুষী নারী।
সূত্র সাহিত্যের ছয়টি সূত্র কী?উঃ সূত্র সাহিত্যের ছয়টি সূত্র হল—(ক) শিক্ষা, (খ) ছন্দ, (গ) ব্যাকরণ, (ঘ) নিরুক্ত, (ঙ) জ্যোতিষ ও (চ) কল্প।
ষড়দর্শনের নাম কী ?উঃ ষড়দর্শন হল – (ক) সাংখ্য, (খ) যােগ, (গ) ন্যায়, (ঘ) বৈশেষিক, (ঙ) পূর্ব মীমাংসা, (চ) উত্তর মীমাংসা।
আর্য সভ্যতাকে লৌহযুগের সভ্যতা বলা হয় কেন ?উঃ আর্য সভ্যতায় সর্বপ্রথম লােহার ব্যবহার শুরু হয়, সেজন্য আর্য সভ্যতাকে লৌহযুগের সভ্যতা বলা হয়।
‘কুসীদ’ ও ‘কুসীদিন’ কী ?উঃ কুসীদ বলতে ঋণ ও কুসীদিন বলতে ঋণদাতাকে বােঝায়।
ঋগবৈদিক যুগে সমাজ ও অর্থনীতির ভিত্তি কী ছিল ? উঃ ঋগবৈদিক যুগে সমাজ ও অর্থনীতির ভিত্তি ছিল কৃষি ও পশুপালন।