Thursday, 26 March 2020

দক্ষিণ ভারতের ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতার (বিরোধের) কারণ ও ফলাফল ব্যাখ্যা কর। এই দ্বন্দ্বে ফরাসিদের ব্যর্থতার কারণ ব্যাখ্যা কর।

ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা
ভারতে একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দুই বিদেশি শক্তি ইংরেজ ও ফরাসিরা পরস্পরের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়। দাক্ষিনাত্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কর্নাটককে কেন্দ্র করে সংগঠিত এই দ্বন্দ্ব ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা (কর্নাটক যুদ্ধ) নামে পরিচিত। ১৭৪০ থেকে ১৭৬৩ পর্যন্ত মোট তিনটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যথা, প্রথম (১৭৪৬-৪৮), দ্বিতীয় (১৭৪৯-৫৪), তৃতীয় (১৭৫৭-৬৩)।
প্রতিদ্বন্দ্বিতার পটভূমি / কারণ
দাক্ষিণাত্যে ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে বিরোধের পটভূমি ব্যাখ্যা করলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণ জানা যাবে।
1.  মার্কেন্টাইল মতবাদ। অষ্টাদশ শতকের এই মতবাদে বলা হয়, কোন জাতিকে সম্পদশালী হতে হলে তাকে বিশ্ববাণিজ্যে একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েই ইংরেজ ও ফরাসিরা পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের মতো দক্ষিণ ভারতেও বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে।
2.  মোঘল শক্তির দুর্বলতা। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোঘল শক্তির দ্রুত অবক্ষয় শুরু হয়। অন্যদিকে মোঘলদের শক্তিশালী নৌবহর না থাকার সুযোগে ইংরেজ ও ফরাসি শক্তি নিজেদের বাণিজ্যিক আধিপত্য বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করে।
3.  অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ইংল্যান্ড অস্ট্রিয়াকে ও ফ্রান্স প্রাশিয়াকে সমর্থন করে। ইউরোপের এই রাজনৈতিক সংঘর্ষের জেরে কর্নাটকের ইংরেজ ও ফরাসি গোষ্ঠি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
4.  দেশীয় রাজাদের দুর্বলতা। ইউরোপীয় শক্তির তুলনায় ভারতের দেশীয় রাজারা দুর্বল ছিল। অন্তর্কলহ এর অন্যতম কারণ। ইংঙ্গ-ফরাসি শক্তি এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশীয় রাজাদের পুতুল শাসকে পরিণত করে বানিজ্যে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার নীতি গ্রহণ করে।

এইভাবে ইঙ্গ-ফরাসি শক্তির ভারতীয় বাণিজ্যে একচেটিয়া আধিপত্যের লোভ এবং দেশীয় রাজাদের অন্তর্কলহ জনিত দুর্বলার প্রেক্ষাপটে দক্ষিণভারতে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। এর অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসাবে ইংরেজ ও ফরাসি কোম্পানী পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে।
ফরাসিদের ব্যর্থতার ( পরাজয়ের ) কারণ
অথবা, ইংরেজদের জয়লাভের কারণ
প্রথম দিকে সাফল্য পেলেও কিছু নির্দিষ্ট কারণে ফরাসিরা এই যুদ্ধে পরাজিত হয় এবং ইংরেজরা সাফল্য পায় –
1)  বাংলায় আধিপত্য। পলাশির যুদ্ধের পর ইংরেজ কোম্পানি বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হওয়ার কারণে প্রচুর সম্পদ ও একচেটিয়া বাণিজ্যের মালিক হয়ে যায়। ফলে, তারা একপ্রকার অপরাজেয় হয়ে ওঠে। বলা হয়, ‘পলাশির যুদ্ধই প্রকৃতপক্ষে ভারতে ফরাসিদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়।
2)   বাণিজ্যে গুরুত্বদান। ইংরেজরা ভারতীয় রাজনীতিতে অংশ নিলেও বাণিজ্যকে কখনও উপেক্ষা করে নি। কিন্তু ফরাসিরা উলটো পথে হাটায় আর্থিক সংকটে পড়ে।
3)  নৌবহরের উপস্থিতি। ইংরেজদের শক্তিশালী নৌবহর ছিল। এবং এর দ্বারা তারা ভারতের উপকূল্ভাগ নিয়ন্ত্রন করত। কিন্তু ফরাসিদের তা ছিল না। ফলে, বিভিন্ন যুদ্ধে তারা পিছেয়ে পড়ে।
4)   বাজার দখলের তাগিদ। অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিল্পব হয়। শিল্পের প্রয়োজনে ইংরেজরা কাঁচামাল সংগ্রহ ও শিল্পপন্য বিক্রির জন্য ভারতের বাজার দখলে প্রবল উৎসাহ দেখায়। কিন্তু ফরাসি কোম্পানি এ বিষয়ে তেমন উৎসাহ দেখায় নি।
5)  জনসমর্থন। ব্রিটিশ কোম্পানি ছিল জনগণের প্রতিষ্ঠান। তাই এর পিছনে ব্যপক জনসমর্থন ছিল, যা কোম্পানির আধিকারিক এবং কর্মচারিদের উৎসাহিত করত। কিন্তু ফরাসি কোম্পানি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হওয়ায় এখানে জনসমর্থন সেভাবে ছিল না। তাই প্রথম থেকেই ফরাসি কোম্পানি দুর্বল ছিল।
6)   উপনিবেশ রক্ষায় আগ্রহ। সপ্তবর্ষের যুদ্ধের সময় ইউরোপ ও আমেরিকায় ইঙ্গ-ফরাসি বিবাদ চললেও ভারতে উপনিবেশ রক্ষায় ইংরেজরা যথেষ্ট আগ্রহ দেখায়। এক্ষেত্রে মাতৃভূমি থেকে কোম্পানি যথেষ্ট সাহায্য পায়। কিন্তু ফরাসি কোম্পানি এক্ষেত্রে এধরণের আগ্রহ ও সাহায্য কোনোটাই তেমন পায়নি।
7)   সেনাপতিদের যোগ্যতা। ইঙ্গ-ফরাসি বিবাদের সময় সান্ডার্স, আয়ার কূট, ফোর্ড, লরেন্স প্রমূখ ইংরেজ সেনাপতি যুদ্ধে অসামান্য যোগ্যতা ও দক্ষতা দেখিয়ে ছিলেন। কিন্তু ফরাসিদের সেনাপতিদের চারিত্রিক ত্রুটি ও তীব্র অন্তর্দন্দ্ব তাদের সাফল্যের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
8)  কর্তৃপক্ষের ভুল সিদ্ধান্ত। ফরাসি কর্তৃপক্ষের কয়েকটি মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত যেমন - ডুপ্লের অপসারণ, তাঁর নীতির পরিবর্তে নতুন নীতি গ্রহণ, হায়দ্রাবাদ থেকে সেনাপতি বুসিকে অপসারণ ইত্যাদি পদক্ষেপগুলি ভারতে ইংরেজদের সুবিধা করে দিয়েছিল।
যুদ্ধের ফলাফল বা প্রভাব
১৭৬৩ সালে প্যারিসের সন্ধি দ্বারা ভারতে ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতার (কর্নাটক যুদ্ধের) অবসান ঘটে। ভারতের ইতিহাসে এই দ্বন্দ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়েছিল –
1)  দেশীয় রাজাদের অবস্থা। এই দ্বন্দ্বের ফলে দেশীয় রাজা মহম্মদ আলী ও সলাবৎ জঙ্গ ইংরেজদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়।
2)  দেশীয় শাসকদের সামরিক দুর্বলতা। যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইংরেজরা বুঝতে পারে যে, দেশীয় শাসকদের দুর্বলতা ও পারস্পরিক বিরোধ ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্যের প্রসার ঘটাতে খুবই সাহাকয্য করবে।
3)  নতুন সমরকৌশল। ইংরেজরা আরও বুঝতে পারে, ভারতীয় সৈন্যদের ইউরোপীয় পদ্ধতিতে শিক্ষা দিলে তারা ইউরোপীয় সৈন্যের সমকক্ষ হতে পারে। তাই তারা এই সময় থেকে নতুন সমরকৌশল বা নীতি গ্রহণ করে।
4)  ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের প্রসার। কর্নাটকের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ভারতে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তি আরও দৃঢ় হয় বলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন।
5)  ফরাসিদের স্বপ্নভঙ্গ। কর্নাটকের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে ভারতে ফরাসি সাম্রাজ্য স্থাপনের আশা সম্পূর্ণ ধুলিসাৎ হয়ে যায়।
6)  বাণিজ্যে একচেটিয়া অধিকার। যুদ্ধ জয়ের ফলে ইংরেজ শক্তি ভারতের বহির্বাণিজ্য ও অন্তর্বাণিজ্যে তাদের একচেটিয়া অধিকার কায়েম করে।
উপসংহার
সর্বোপরি, ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইংরেজদের জয়লাভ গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। এপ্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ফিলিপ বলেছেন – এই যুদ্ধের ফলে ভারতে বিদেশি আধিপত্যের পথ উন্মুক্ত হয়।
Comment

Class XI Political Science

Class XII Political Science

Class 12 Bangla Books Question& Answers