Thursday, 26 March 2020

১৭৬০ সালের বিপ্লব’ বলতে কী বোঝ? এপ্রসঙ্গে মিরকাশিমের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধের কারণ ব্যাখ্যা কর। বক্সার যুদ্ধের তাৎপর্য উল্লেখ কর।

১৭৬০ সালের বিপ্লব কী
পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার ‘কিং মেকার’-এ পরিণত হয়। মিরজাফরকে সিংহাসনে বসিয়ে তারা বাংলায় বিনাশুল্কে বানিজ্যের অবাধ অধিকার ও চব্বিশ পরগণার জমিদারি লাভ করে। কিন্তু ক্লাইভের উদ্ধত আচরণ, নবাবের প্রতি অসম্মান, ক্রমাগত অর্থশোষণ প্রভৃতি কারণে মিরজাফর বিরক্ত হন। ইংরেজদের ক্ষমতা ক্ষর্ব করার জন্য তিনি গোপনে ওলন্দাজদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। খবর পেয়ে ক্লাইভ বিদারার যুদ্ধে ওলন্দাজদের পরাজিত করন। আর ওলন্দাজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে মিরজাফরকে পদচ্যুত করে তাঁর জামাতা মিরকাশিমকে বাংলার সিংহাসনে বসান। এভাবে বিনা রক্তপাতে নবাব পরিবর্তনের ঘটনা ‘১৭৬০ সালের বিপ্লব’ নামে পরিচিত।
ইংরেজ ও মিরকাশিমের বিরোধের কারণ
ইংরেজদের সহযোগীতায় ক্ষমতা দখল করলেও মিরকাশিম ইংরেজদের ওপর নির্ভরতা কমানোর উদ্দেশ্যে শিঘ্রই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফলে তাঁর সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
1)  আর্থিক শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টা। এই উদ্দেশ্যে মিরকাশিম ১) রাজস্ব আদায়ের কঠোর নীতি নেন, ২) দরবারের ব্যয় সংকোচন করেন, ৩) দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মচারিদের বরখাস্ত করেন, ৪) তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন এবং ৫) বিদ্রোহী জমিদারদের দমন করেন।
2)   সামরিক শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা। সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শক্তিবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মিরকাশিম সমরু, মার্কার ও জেন্টিল নামে তিনজন ইউরোপীয় সেনাপতি নিয়োগ করেন। মুঙ্গেরে একটি কামান ও বন্দুক নির্মানের কারখানা গড়ে তোলেন।
3)  রাজধানী স্থানান্তর। ইংরেজদের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর রাজধানী মুরশিদাবাদ থেকে বিহারের মুঙ্গেরে স্থানান্তরিত করেন।
4)   কর্মচারি বিতাড়ন। মিরকাশিম লক্ষ্য করেন, তাঁর কিছু কর্মচারি ইংরেজদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তিনি এই সব কর্মচারীদের বিতাড়িত করেন।
5)  ফরমান লাভ। মিরকাশিম বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা রাজস্বের বিনিময়ে মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে নবাবী ফর্মান লাভ করেন।
6)   শুল্ক-বিবাদ। ইংরেজরা দস্তকের অপব্যবহার করায় নবাব রাজস্ব ঘাটতির সম্মুখিন হন। দেশীয় বণিকরাও এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে মিরকাশিম দেশীয় বনিকদের বাণিজ্য শুল্ক তুলে দেন। ফলে ইংরেজ বণিকরা প্রতিযোগীতার সম্মুখিন হন।

এভাবে মিরকাশিমের বিভিন্ন আর্থিক, সামরিক, প্রশাসনিক ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহন করায় ইংরেজরা তাঁর বিরুদ্ধে ক্রমশঃ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে দেশীয় বণিকদের বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার সুবিধা দিলে ইংরেজরা নবাবের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪)।
বক্সার যুদ্ধের গুরুত্ব
ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র বলেছেন, ভারতের ইতিহাসে বক্সারের এই যুদ্ধটিন ছিল সর্বাধিক যুগান্তকারী ও তাৎপর্যপূর্ণ। পলাশি ও বক্সারের যুদ্ধের ফলাফলের তুলনামূলক আলোচনা করলে এই যুদ্ধের তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায় –
1)  সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তি সুদৃঢ়। পলাশি যুদ্ধের দ্বারা ভারতে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়, বক্সারের যুদ্ধের দ্বারা তার ভিত্তি আরও দৃঢ় হয়।
2)  প্রকৃত যুদ্ধ। পলাশির যুদ্ধজয়ে শক্তির চেয়ে কূটনীতি ও বিশ্বাসঘাতকতার ভূমিকা বেশি ছিল। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধ ছিল প্রকৃত ও চুড়ান্ত ফল-নির্ণয়কারী যুদ্ধ। ঐতিহাসিক স্মিথের মতে, পলাশির যুদ্ধ ছিল কয়েকটি কামানের লড়াই, বক্সার ছিল চূড়ান্ত বিজয়।
3)  শাসনক্ষেত্রে আধিপত্য। পলাশির যুদ্ধে জিতে বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির জয়যাত্রার সূচনা হয়। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধে শাসনক্ষেত্রে চূড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নবাব কোম্পানির বৃত্তিভোগী হাতের পুতুলে পরিনত হয়। র‍্যামসে মুরের মতে, ‘বক্সার বাংলার ওপর কোম্পানির শাসনের শৃঙ্খল চূড়ান্তভাবে স্থাপন করে’।
4)  অর্থনৈতিক আধিপত্য। পলাশির যুদ্ধে জিতে কোম্পানি দস্তক নির্ধারিত পণ্যে বিনাশুল্কে বাণিজ্যিক অধিকারের সফল প্রয়োগ ঘটায়। কিন্তু বক্সারের পরে লবণ ছাড়া সমস্ত পণ্যে এই অধিকার স্বীকৃত হয়। অন্যান্য ইউরোপীয় সহ দেশীয় বণিকদের বাণিজ্য ধ্বংস হতে থাকে।
5)  সাম্রাজ্যের প্রসার। পলাশির যুদ্ধে শুধু বাংলার নবাব পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু বক্সারের বাংলার নবাবের সাথে অযোধ্যার নবাব ও দিল্লির বাদশাহও পরাজিত হন। ফলে সমগ্র উত্তর ভারতে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
6)  দেওয়ানি নাভ। যুদ্ধের পর কোম্পানি দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে দেওয়া লাভ করেন। ফলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের অধিকার আইনগত বৈধতা পায়।

সুতরাং বক্সারের যুদ্ধ ছিল ভারত ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পলাশি ‘যদিও নির্ণায়ক যুদ্ধ, তথাপি কখনই বৃহৎ যুদ্ধরূপে বিবেচিত হতে পারে না’ (Plassey though decisive, can never be considered as a great battle) – ম্যালেসন। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধ ছিল ‘এক চূড়ান্ত যুদ্ধ’(a decisive battle) – স্মিথ।
Comment

Class XI Political Science

Class XII Political Science

Class 12 Bangla Books Question& Answers