Tuesday, 7 April 2020

গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর

গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র
প্রশ্ন ১) গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলতে কী বােঝায়?
উত্তর : গণতন্ত্র কথাটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল, —“Democracy”। এই শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দ, “Demos”  “Kratos” শব্দ থেকে এসেছে। Demos -এর অর্থ হল জনগণ এবং Kratos –এর অর্থ হল শাসন। সুতরাং আক্ষরিক অর্থে জনগণের শাসনকে বলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা।
     তথাপি গণতন্ত্রের সংজ্ঞা সম্পর্কে রাষ্টবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্টের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন এর দেওয়া সংজ্ঞা বিশেষ উল্লেখযােগ্য। তিনি বলেছেন, “Democracy is a government of the people, by the people and for the people,” অর্থাৎ গণতন্ত্র হল জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন।
     জনগণের দ্বারা (by the people) বলতে সমগ্র জনগণের দ্বারা বােঝালেও বর্তমানে রাষ্ট্রের বৃহৎ আয়তনের জন্য জনগণ প্রতিনিধি নির্বাচন করে। যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়, তারাই দেশ শাসন করে। সেই কারণে বর্তমানে গণতন্ত্রকে বলা হয় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র।
     জনগণের শাসন (of the people) বলতে বােঝায়, জনগণের প্রয়ােজন এবং ইচ্ছানুসারে সরকার নীতিনির্ধারণ করবে।
     জনগণের জন্য (for the people) বলতে বােঝায়, জনগণের কল্যাণের জন্য সরকার কাজ করবে। গণতন্ত্র বিশ্বাস করে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একটা সুপ্ত শক্তি আছে। তার বিকাশসাধনের জন্য গণতান্ত্রিক সরকার সচেষ্ট হবে।
     সুতরাং বলা যায়, যে শাসনব্যবস্থায় জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এবং সেই কারণে এটি জনগণের দ্বারা বা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হয় এবং যেখানে জনগণের ইচ্ছা অনুসারে নীতি নির্ধারিত হয় এবং যার উদ্দেশ্য হল, জনগণের কল্যাণ ও বিকাশসাধন করা, তাকে বলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা।
প্রশ্ন ২) গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কী সুবিধা আছে?
উত্তর : বর্তমানে গণতন্ত্র সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা হিসাবে স্বীকৃত। প্রকৃতপক্ষে এখন এর কোনাে বিকল্প নেই। মিল, বার্কার, ল্যাস্কি প্রভৃতি চিন্তাবিদরা গণতন্ত্রকে সমর্থন করেছেন। এর সুবিধাগুলি হল নিম্নরূপ-
• (ক) সাম্যনীতি
গণতন্ত্র সাম্যনীতিতে বিশ্বাসী। এখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে আইনের চোখে সকলে সমান। প্রত্যেকে সমান মর্যাদা ও সমান সুযােগসুবিধার অধিকারী। ভারত গণতান্ত্রিক দেশ বলে সংবিধানের ১৪নং থেকে ১৮নং ধারায় এই নীতি স্বীকৃত হয়েছে।
• (খ) বিপ্লবের আশঙ্কা কম
মানুষ পরিবর্তন চায়। বিশেষ করে স্বৈরাচারী সরকারের পরিবর্তন কাম্য। যখন সহজে তা হয় না, তখন রক্তাক্ত বিপ্লবের পথ নেয়। কিন্তু তাতে জনগণকে অনেক মূল্য দিতে হয়। গণতন্ত্রে বুলেটের পরিবর্তে ব্যালটের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিবর্তন সম্ভব বলে এখানে বিপ্লবের সম্ভাবনা খুবই কম থাকে।
• (গ) মৌলিক অধিকার ভােগ
ব্যক্তির বিকাশের জন্য অধিকার ভােগের সুযােগ থাকা দরকার। গণতন্ত্রে জনগণ এই অধিকার ভােগ করতে পারে। শুধু তাই নয়, অধিকার ভঙ্গের ক্ষেত্রে প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে। যেমন, ভারতের সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকারের উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে প্রতিকারের ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছে।
• (ঘ) স্বৈরাচারীতা রােধ
গণতন্ত্রে সরকার স্বৈরাচারী হতে পারে না। কারণ, এখানে শাসকগােষ্ঠী তাদের কাজের জন্য আইনসভা ও জনগণের কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য থাকে। জনগণ সরকারের সমালােচনা করে তাকে সংযত করে রাখে।
• (ঙ) দেশপ্রেম বৃদ্ধি
গণতন্ত্রে জনগণ নিজেরা সরকার গড়ে এবং তার পরিবর্তন ঘটায়। তাই সরকারকে নিজেদের সরকার বলে মনে করে। এতে সরকারের ও দেশের প্রতি ভালােবাসা জন্মায়।
• (চ) রাজনৈতিক চেতনার প্রসার
গণতন্ত্রে জনগণ শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করার সুযােগ পায়। বিশেষ করে গণতন্ত্রে স্বীকৃত স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থায় অনেক বেশি মানুষ শাসনকার্যে অংশ নেয়। এতে রাজনৈতিক চেতনার ব্যাপক প্রসার ঘটে।
• (ছ) আইনের অনুশাসন
গণতন্ত্রে আইনের অনুশাসন থাকে। অর্থাৎ আইনকে সকলের উপরে স্থান দেওয়া হয়। আইনের চোখে দোষী প্রমাণিত হলে, তবে মানুষ শাস্তি পাবে। খেয়াল-খুশিমতাে কেউ শাস্তি দিতে পারবে না। পদমর্যাদার সুযােগ নিয়ে কেউ শাস্তি এড়িয়ে যেতে পারবে না।
প্রশ্ন ৩) গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ত্রুটিগুলি ব্যাখ্যা করাে।
উত্তর : গণতন্ত্র শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা হলেও অ্যারিস্টটল, কার্লাইল, হেনরি মেইন প্রমুখরা এর সমালােচনা করেছেন। তাদের যুক্তিগুলি হল—
• (ক) অশিক্ষিতের শাসন
গণতন্ত্রে বেশিরভাগ মানুষই অশিক্ষিত ও অজ্ঞ। তাদের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা ভালাে হতে পারে না। কার্লাইল তাই বলেছেন, “Democracy is a government of the fools, for the fools and by the fools.” অর্থাৎ গণতন্ত্র হল মূর্খদের দ্বারা, মূর্খদের জন্য, মূর্খদের শাসন।
• (খ) অস্থায়ী শাসন
হেনরি মেইন গণতন্ত্রকে অস্থায়ী শাসনব্যবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ, স্বার্থের দ্বন্দ্বে যে-কোনাে সময় সরকার ভেঙে যেতে পারে। ফলে উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যাহত হয়। বারবার নির্বাচনে অর্থের অপচয় হয়।
• (গ) দলব্যবস্থার কুফল
দলব্যবস্থার কুফল আছে। গণতন্ত্রে সেগুলি প্রকট হয়। যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে, দলের স্বার্থকে বড়াে করে দেখে। দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়ােগ হয়। তাতে প্রশাসনের মান নেমে যায়।

• (ঘ) ব্যয়বহুল
গণতরে নিদিষ্ট সময় অন্তর নির্বাচন হয়। তা ছাড়া, মধ্যবর্তী নির্বাচনও হয়। এতে অনেক অর্থের অপচয় হয়। তাই অনেকেই দরিদ্র দেশে গণতন্ত্রকে বিলাসিতা বলে মনে করে।
• (ঙ) রক্ষণশীলতা
জনগণের অধিকাংশ অশিক্ষিত ও অজ্ঞ। গণতন্ত্রে তারাই প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত হয়। তারা সাধারণত রক্ষণশীল হয়। তাই তারা কোনাে প্রগতিশীল সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
• (চ) সংখ্যালঘুদের স্বার্থহানি
গণতন্ত্র হল জনগণের শাসনব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তবে গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠেরা সরকার গঠন করে নিজেদের স্বার্থপূরণের চেষ্টা করে। ফলে সংখ্যালুঘদের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।
• (ছ) আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য
গণতন্ত্রে সাধারণত মন্ত্রীদের যােগ্যতার অভাব থাকে। এই সুযােগে আমলারা শাসনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। জনসাধারণের সুখ-দুঃখের সঙ্গে তাদের কোনাে সম্পর্ক থাকে না। অনুভূতিও থাকে না।
• (জ) যােগ্যতার কদর নেই
গণতন্ত্রে যােগ্যতার বিশেষ স্থান নেই। কারণ, গুণের বিচারে নয়, সংখ্যার বিচারে এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তাই নিৎসে বলেছিলেন, গণতন্ত্র হল জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিদের প্রতি অবজ্ঞা।
প্রশ্ন ৪) উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করাে।
উত্তর : অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাসে ইউরােপে সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে পুঁজিপতি শ্রেণির ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য গণতন্ত্রের মতাদর্শ প্রচার করা হয়। এর ফলে ব্রিটেনে গৌরবময় বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রাম সংগঠিত হয়। জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, যে শাসনব্যবস্থায় জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে শাসন পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে তাকেই গণতন্ত্র বলে। বার্কার, ডাইসি প্রমুখ উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। টমাস পেইন, মন্তেস্কু, মিল প্রমুখের দর্শনে প্রভাবিত হয়ে মার্কিন সংবিধান রচিত হয়।
উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
     রাজনৈতিক সাম্যের উপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়। রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য মার্কিন সংবিধানে নির্বাচনে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, সভাসমিতির অধিকার ইত্যাদির উপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে।
     উদারনৈতিক গণতন্ত্র জনগণের উন্মুক্ত দল ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক দল ব্যবস্থা লক্ষ করা যায়।
     উদারনৈতিক গণতন্ত্র সার্বজনীন ভােটাধিকারকে গণতন্ত্রের সাফল্যের প্রধান শর্ত মনে করে। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্টে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিক ভােটদানের অধিকারী।
     ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার হল উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ভিত্তি। মার্কিন সংবিধানে গণতন্তের ভাবমুর্তি রক্ষার জন্য বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মৌলিক নীতি হিসাবে কাজ করে। মার্কিন সংবিধানে সুপ্রিমকোর্টকে সবার ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন ৫) সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের অর্থ কী?
উত্তর : সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র শব্দটি রাষ্টদর্শনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯১৭ সালে সােভিয়েত দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর উদারনৈতিক গণতন্ত্রের পরিবর্তে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে। উদারনৈতিকগণতন্ত গণতন্ত্রের আদর্শকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ করার পক্ষপাতী। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র হল এরপ এক ব্যবস্থা যেখানে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের ভিত্তি হল মার্কসবাদ ও লেনিনবাদ। এরূপ গণতন্ত্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা যায় —(ক) অর্থনৈতিক সাম্য, (খ) একদলীয় ব্যবস্থা, (গ) অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের স্বীকৃতি, (ঘ) ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলােপ, (ঙ) রাষ্ট্রকর্তৃক শ্রম ও ভােগের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ।
     সুতরাং, সমাজতান্ত্রিকগণতন্ত্র সমস্ত ক্ষেত্রেই সাম্য প্রতিষ্ঠার মধ্যেই আদর্শ গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করে। এই দিক থেকে গণতন্ত্রের তুলনায় সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে শ্রেষ্ঠ বলা যায়। (Socialist Democracy is a better form of democracy based on the rule of majority over minority.)
প্রশ্ন ৬) প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলতে কী বােঝ? প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের গুণাগুণ আলােচনা করাে।
উত্তর : গণতন্ত্র দুই প্রকারের, প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ গণতন্ত্র। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে জনগণ সরাসরি শাসন কাজে অংশগ্রহণ করে। প্রাচীন গ্রিস দেশের নগর রাষ্ট্রগুলিতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চালু ছিল। বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের কয়েকটি ক্যান্টনে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চালু আছে। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের কয়েকটি সুবিধা আছে। তা হল—
সুবিধা
(ক) প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে নাগরিকগণ প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রপরিচালনায় অংশগ্রহণ করে বলে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায়। তাদের মধ্যে দায়িত্ববােধ বৃদ্ধি পায়।
(খ) নাগরিকদের মধ্যে স্বদেশপ্রীতির মনােভাব জাগরিত হয়।
(গ) প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র অত্যন্ত সহজ সরল। কারণ শাসনব্যবস্থার সব কাজ জনগণ নিজেরাই সম্পাদন করে।
(ঘ) এইরূপ শাসনব্যবস্থা ব্যয়বহুল নয়।
(ঙ) পরােক্ষ গণতন্ত্রের কুফলগুলি প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে দেখা যায় না।
(চ) দ্রুত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। কারণ জনগণ সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে।
অসুবিধা
(ক) বৃহৎ রাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র অচল।
(খ) প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে ধরে নেওয়া হয় যে, জনগণ রাজনীতিতে সচেতন, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে সবাই সচেতন নয়।
(গ) প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র অনেক সময় সমাজে বিশৃঙ্খলা ডেকে আনে।
প্রশ্ন ৭) পরােক্ষ গণতন্ত্রের গুণাগুণ আলােচনা করাে।
উত্তর : শাসনব্যবস্থা বলতে পরােক্ষ গণতন্ত্রকে বােঝায়। পরােক্ষ গণতন্ত্রে জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনসভায় বা স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠানে জনপ্রতিনিধি প্রেরণ করে ও জনগনের প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসন কার্য পরিচালিত হয় বলে এই ধরনের শাসনব্যবস্থাকে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলা হয়। এইরূপ গণতন্ত্রে জনপ্রতিনিধিরা জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকেন। আজকের দিনে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই পরােক্ষ গণতন্ত্র দেখতে পাওয়া যায়।
পরােক্ষ গণতন্ত্রের সুবিধা
(ক) বৃহৎ রাষ্ট্রের পক্ষে পরােক্ষ গণতন্ত্র সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত।
(খ) এই শাসনব্যবস্থায় সমস্ত নাগরিকের পরিবর্তে শাসন পরিচালনায় অংশগ্রহণে ইচ্ছুক কিছু ব্যক্তি নির্বাচিত হয় জনগণের দ্বারা। এর ফলে যােগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা সরকার পরিচালিত হয় বলে ধরে নেওয়া হয়।
(গ) এইরূপ শাসনব্যবস্থায় শাসকশ্রেণি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয় এবং জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকে।
(ঘ) জনগণ নির্দিষ্ট সময়ের পর সরকার পরিবর্তনের সুযােগ পায়।
পরােক্ষ গণতন্ত্রের অসুবিধা
(ক) পরােক্ষ গণতন্ত্রে অনেক সময় জনপ্রতিনিধিরা জনমতকে উপেক্ষা করে। এর ফলে গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়।
(খ) পরােক্ষ গণতন্ত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে তীব্র প্রতিযােগিতা ও মতভেদ দেখা দেয়। এর ফলে রাজনৈতিক আবহাওয়া দূষিত হয়। অনেক সময় অযােগ্য ও নিম্নমানের অশিক্ষিত ব্যক্তিরা আইনসভায় প্রবেশের সুযােগ পায়।
(গ) এইরুপ শাসনব্যবস্থায় নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি বাসা বাঁধে। অর্থের বিনিময়ে দলত্যাগ ঘটে। নির্বাচনব্যবস্থা প্রহসনে পরিণত হয়।
(ঘ) পরােক্ষ গণতন্ত্র ব্যয়বহুল।
(ঙ) জনপ্রতিনিধিরা জনস্বার্থ বিরােধী কাজ করলে নির্বাচনের আগে অথবা নির্বাচিত হবার পর তাদের অপসারণ করা যায় না। জনমতে সরকার ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে একটা অনীহা দেখা দেয়। তবে এই অসুবিধাগুলি দূর করার জন্য কয়েকটি উপায় আছে। এগুলিকে বলা হয় প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিগুলি হল গণভােট, গণউদ্যোগ ও প্রতিনিধি প্রত্যাহার। সুইজারল্যান্ডের শাসনব্যবস্থায় গণভােট এবং গণউদ্যোগের ব্যবস্থা আছে।
প্রশ্ন ৮) ভারতে গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তগুলি আলােচনা করাে।
উত্তর : সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে গণতান্ত্রিক দেশ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। গণতন্ত্রকে সফল করার জন্যে সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তথাপি ভারতে গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তগুলি কতটুকু আছে, তা নিয়ে বির্তকের অবকাশ আছে।
অধিকাংশ শর্ত নেই
প্রথমত, অর্থনৈতিক সাম্য গণতন্ত্রের ভিত্তি। কিন্তু ভারতে তা নেই। এখনও প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করে। ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ছে। বেকারত্ব গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে।
দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্রের সাফল্যের একটি শর্ত হল শিক্ষা। কিন্তু ভারতে আজও প্রায় অর্ধেক মানুষ অক্ষরজ্ঞানহীন। এই কারণে তারা কুসংস্কারের শিকার হয়েছে। অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারেনি।
তৃতীয়ত, গণতন্ত্রকে সফল করতে বলিষ্ঠ জনমতের প্রয়ােজন। এর জন্যে সঠিক সংবাদ পরিবেশন দরকার। কিন্তু ভারতে সংবাদের মাধ্যমগুলি যেমন—রেডিয়াে এবং টেলিভিশন সরকার নিয়ন্ত্রিত। আবার সংবাদপত্রগুলি ধনিকশ্রেণির কুক্ষিগত। তাই সত্য সংবাদ পরিবেশিত হয় না।
চতুর্থত, ভারতে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে দক্ষতা এবং কর্মনিষ্ঠার একান্ত অভাব আছে। দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এতে গণতন্ত্র কখনােই সফল হতে পারে না।
পঞ্চমত, ভারতে বিরােধীদের মধ্যে ঐক্য না থাকায় শক্তিশালী বিরােধী দল গড়ে ওঠেনি। তা ছাড়া, দলগুলির মধ্যে সহনশীলতারও অভাব আছে।।
সাফল্যের শর্ত আছে
প্রথমত, ভারতে সার্বজনীন ভােটাধিকার স্বীকৃত। ১৮ বছর বয়সের নাগরিকদের ভােটাধিকার দেওয়া হয়েছে। নাগরিকদের মধ্যে ভােটদানের উৎসাহ দেখা যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, এখানে লিখিত সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকার ও তার প্রতিবিধানের অধিকার সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা হয়েছে।
তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অনুন্নত জাতিদের জন্য বিশেষ সুযােগসুবিধা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশমূলক নীতিতে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।
চতুর্থত, ভারতে নিরপেক্ষ আদালত হিসাবে সুপ্রিমকোর্ট আছে। এই আদালত সংবিধানের ব্যাখ্যা ও জনগণের অধিকার রক্ষা করে।
পঞ্চমত, পঞ্চায়েতিব্যবস্থা চালু করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে।
প্রশ্ন ৯) একনায়কতন্ত্রের সংজ্ঞা নির্দেশ করাে।
উত্তর : পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থা জন্ম নিয়েছে। যেমন, রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র প্রভৃতি। এদের মধ্যে নিন্দিত শাসনব্যবস্থা হল একনায়কতন্ত্র। প্রাচীনকালে একনায়কতন্ত্রী শাসনব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছিল। তবে আধুনিক একনায়কতন্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি এবং কর্মপরিধি প্রাচীনকালের একনায়কতন্ত্রের সীমারেখাকে ছাড়িয়ে গেছে।
     একনায়কতন্ত্র বলতে বােঝায় —একজন নায়কের শাসন। এটি গণতন্ত্রের বিপরীতধর্মী। গণতন্ত্রে বহুজনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। একনায়কতন্ত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় একজনের শাসন। একনায়ক রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে সব বিরােধী শক্তিকে নস্যাৎ করে অবাধ ও চুড়ান্ত ক্ষমতা প্রয়ােগ করে দেশ চালায়। একজনের এই অবাধ এবং অপ্রতিহত শাসনকে বলে একনায়কতন্ত্র। নিউম্যানের ভাষায় বলা যায়, -“একনায়কতন্ত্র বলতে বােঝায় এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে কোনাে ব্যক্তি বা কয়েকজন ব্যক্তি ক্ষমতা দখল করে অবাধে স্বৈরী ক্ষমতা প্রয়ােগ করে।”
     একনায়কতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল -একটি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব। সংবাদপত্র; বেতার ও টেলিভিশনের উপর রাষ্ট্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এবং রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি—এই নীতিকে প্রতিষ্ঠা করা। একনায়কতন্ত্রের আধুনিক উদাহরণ হল—জার্মানির হিটলার ও ইটালিতে মুসােলিনির শাসন।

প্রশ্ন ১০) একনায়কতন্ত্রের সুবিধাগুলি আলােচনা করাে।
উত্তর : একনায়কতন্ত্র হল গণতন্ত্রবিরােধী। তাই এটি জনগণের কাছে স্থায়ীভাবে গ্রহণযােগ্য নয়। তথাপি এর কতকগুলি গুণ আছে যা অস্বীকার করা যাবে না।
• (ক) দক্ষ ব্যক্তির শাসন
কার্লাইল বলেছেন—গণতন্ত্র হল নির্বোধের শাসন। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে দক্ষ ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। দক্ষ ব্যক্তির নেতৃত্বে দেশ সহজে এগিয়ে যেতে পারে।
• (খ) দলীয় কোন্দল থাকে না
গণতন্ত্রে অনেক দল থাকে। এদের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে আইনসভা যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ ধরে। দলত্যাগ এবং আইনসভার সদস্যদের বেচাকেনা গণতন্ত্রকে কলুষিত করে। তাই কাজের কাজ কিছু হয় না। একনায়কতন্ত্রে দলীয় কোন্দল শাসনব্যবস্থাকে কলুষিত করে না।
• (গ)জরুরি অবস্থার উপযােগী
দেশের সংকটকালে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তা না হলে দেশ সংকটের মধ্যে পড়ে। একনায়ক এককভাবে অবাধ ক্ষমতাভােগ করে বলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
• (ঘ)স্বদেশপ্রেম জাগায়
সাধারণত জাতির জীবনে যখন হতাশা আসে, তখন একনায়কের আবির্ভাব হয়। সে জাতীয় জীবনে নতুন আশা জাগিয়ে জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
• (ঙ)আর্থিক উন্নতি সম্ভব
দেশের আর্থিক কাঠামােকে শক্তিশালী করতে হলে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হয় বলে দ্রুত উন্নতির পথ প্রশস্ত হয়।
• (চ)সমাজে শান্তি আসে
গণতন্ত্রে জননেতাদের আশ্রয়পুষ্ট হয়ে দুষ্কৃতকারীরা অবাধে দৌরাত্ম্য করে। সমাজজীবনে শান্তি বিঘ্নিত হয়। একনায়কতন্ত্রে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয় বলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রশ্ন ১১) একনায়কতন্ত্রের ত্রুটি বা কী কী অসুবিধা আছে?
উত্তর : • (ক) পশুশক্তির প্রভাব
একনায়কতন্ত্র পশুশক্তিকে আশ্রয় করে টিকে থাকে। জোর করে মানুষের আনুগত্য আদায় করে। আইনের অনুশাসন থাকে না। জনগণ ভয়ে তাকে মান্য করে। তাই তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সহযােগিতা পাওয়া যায় না।
• (খ) স্বাধীনতা ও সাম্য নেই
ব্যক্তির বিকাশের জন্য স্বাধীনতা প্রয়ােজন। একনায়কতন্ত্রে স্বাধীনতা থাকে না। সাম্যনীতি এখানে স্বীকৃত হয় না। কারণ, একনায়কতন্ত্র বিশ্বাস করে, কিছু লােক শাসন করার জন্য জন্মায়, কিছু লােক জন্মায় শাসিত হবার জন্যে।
• (গ) জাতীয়তাবাদের জন্ম
উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রতিটি জাতি নিজের বংশ, সাহিত্য সংস্কৃতি প্রভৃতিকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে অপরের ধর্ম, সংস্কৃতি, প্রভৃতিকে হেয় করার চেষ্টা করে, এমনকি ঘৃণা করে। একনায়কতন্ত্র উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়ে জাতিকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। জাতির ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করে। যেমন, হিটলার বংশগত ঐক্যের ভিত্তিতে উগ্র জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করে বিশ্ব সভ্যতাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিলেন।
• (ঘ) বিপ্লবের সম্ভাবনা
একনায়কতন্ত্রে বিদ্রোহ ও বিপ্লবের সম্ভাবনা থাকে। কারণ, এখানে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের ফলে দমন পীড়ন চলে। শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিকারের কোনাে উপায় থাকে না। তাই ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ক্ষোভ থেকে দেখা দেয় বিপ্লব।
• (ঙ) স্বেচ্ছাচারী শাসন
অ্যাক্টন (Acton) বলেছেন,—“ক্ষমতা মানুষকে কলুষিত করে। বেশি ক্ষমতা বেশি কলুষিত করে।” একনায়ক বেশি ক্ষমতা পেয়ে নিজেকে অভ্রান্ত মনে করে। আকাঙক্ষা সীমাহীন হয়ে যায়। অথচ কোনাে বাধা থাকে না। তখন সে স্বেচ্ছাচারী শাসকে পরিণত হয়।
• (চ) অর্থের অপচয়
একনায়ক ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিরাট গুপ্তচর বাহিনী নিয়ােগ করে। সদাসর্বদা যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টি করতে বিরাট সেনাবাহিনী তৈরি করে। সামরিক খাতে বিরাট খরচ, অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রশ্ন ১২) একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে।
উত্তর :একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ
প্রথমত, একনায়কতন্ত্রে একজন নায়কের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তার হাতে সমস্ত ক্ষমতা থাকে। এই ক্ষমতা সে অবাধভাবে প্রয়ােগ করে। জনগণের কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হয় না।
দ্বিতীয়ত, একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র হল সর্বশক্তিমান। রাষ্ট্র ব্যক্তিকে সব দিক থেকে নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যক্তি এখানে রাষ্ট্রের জন্য। ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয়।
তৃতীয়ত, একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য করা হয় না। তাই ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই বলতেন—“I am the State” অর্থাৎ আমিই রাষ্ট্র।
চতুর্থত, একনায়কতন্ত্রে একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব থাকে। যেমন, হিটলারের সময় জার্মানিতে শুধুমাত্র জাতীয় সমাজতন্ত্রী দলের অস্তিত্ব ছিল।
পঞ্চমত, একনায়কতন্ত্র সাম্যনীতিতে বিশ্বাসী নয়। একনায়কতন্ত্র বিশ্বাস করে, কিছু লােক শাসন করার জন্য জন্মায়। কিছু লােক জন্মায় কেবলমাত্র শাসিত হবার জন্যে।
ষষ্ঠত, একনায়কতন্ত্রে সরকারের স্থায়িত্বের জন্য একনায়কতন্ত্র বিরাট গুপ্তচর বাহিনী গড়ে তােলে। জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বা বিরােধিতা দেখা দিলে, একনায়ক গুপ্তচর মারফত সংবাদ সংগ্রহ করে তা দমন করার চেষ্টা করে। উদাহরণ হিসাবে হিটলারের গেষ্টাপো এবং মুসােলিনির কালাে কোর্তা গুপ্তচর বাহিনীর উল্লেখ করা যায়।
সপ্তমত, মিথ্যা প্রচার একনায়কতন্ত্রের আর একটি বৈশিষ্ট্য। একনায়ক মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে ক্ষমতা দখল করে রাখতে চায়।
অষ্টমত, একনায়কতন্ত্র যুদ্ধবাদকে সমর্থন করে। মুসােলিনি বলেছিলেন,—“মহিলাদের কাছে মাতৃত্ব যেমন, পুরুষদের কাছে যুদ্ধ তেমনি অপরিহার্য।” একনায়কতন্ত্র মনে করেন যুদ্ধের মাধ্যমে মনুষ্যত্বের বিকাশ হয়, সভ্যতা সমৃদ্ধ হয়।
নবমত, একনায়কতন্ত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয়। একনায়কের প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখাতে বলে। এর স্লোগান হল —“বিশ্বাস করাে, মান্য করাে, যুদ্ধ করাে।”
প্রশ্ন ১৩) একনায়কতন্ত্রের শ্রেণিবিভাগ করাে।
উত্তর : একনায়কতন্ত্রের শ্রেণিবিভাগ নিম্নরূপ
• (ক) ব্যক্তিগত ও সামরিক একনায়কতন্ত্র
যখন কোনাে ব্যক্তি রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা দখল করে অবাধে তা প্রয়ােগ করে, তখন তাকে বলা হয় ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্র। সেনাবাহিনীর কোনাে অধিনায়ক যখন সৈন্যদের সাহায্য নিয়ে রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা দখল করে অবাধে স্বৈরী ক্ষমতা প্রয়ােগ করে, তখন তাকে বলে সামরিক একনায়কতন্ত্র। সংবিধান বহির্ভুত উপায়ে ক্ষমতা দখল করে ব্যক্তিগত বা সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। যেমন, পাকিস্তানের আয়ুব খান সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইনসম্মত সরকারকে উচ্ছেদ করে রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করেছিলেন। আবার অনেক সময় আইন অনুমােদিত পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। জার্মানিতে হিটলার এরূপ একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে ব্যক্তিগত হােক বা সামরিক একনায়কতন্ত্র হােক, প্রত্যেকের পিছনে রাজনৈতিক দল বা সামরিক বাহিনীর সমর্থন থাকে।
• (খ) দলগত একনায়কতন্ত্র
একটি দল রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা দখল করে যখন অবাধ ক্ষমতা প্রয়ােগ করে এবং অন্য সব দলের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, তখন তাকে বলে দলগত একনায়কতন্ত্র। ইটালিতে ফ্যাসিস্ট দলের একনায়কতন্ত্র এর উদাহরণ। অবশ্য দলগত একনায়কতন্ত্র শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্রে পরিণত হয়। যেমন, ইটালিতে মুসােলিনি দলের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলেও শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
• (গ) শ্রেণিগত একনায়কতন্ত্র
শ্রেণগত একনায়কতন্ত্র বলতে বােঝায়—কোনাে এক বিশেষ শ্রেণির অবাধ শাসন। মার্কসবাদীদের মতে রাষ্ট্র শ্রেণি-শােষণের যন্ত্র। শােষণের অবসান ঘটাতে সর্বহারা শ্রেণি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। একে বলা হয় শ্রেণিগত একনায়কতন্ত্র। যেমন ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চিনে এই ধরনের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে এই একনায়কতন্ত্র গণতন্ত্রের বিরােধী নয় বলে অনেক মনে করেন। কারণ, এই শাসন শােষণের অবসান ঘটিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে।
প্রশ্ন ১৪) গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের পার্থক্য দেখাও।
উত্তর : গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে প্রকৃতি ও আদর্শগত পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যগুলি হল-
(ক) গণতন্ত্রে শাসকগণ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন এবং জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল থেকে জনগণের স্বার্থে কাজ করেন। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে শাসকগণ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন না। তাই জনগণের নিকট দায়ী থাকেন না।
(খ) গণতন্ত্র ব্যক্তিজীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করে। একনায়কতন্ত্র ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যসাধনের যন্ত্রমাত্র বলে মনে করে। রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি হবে উৎসর্গীকৃত প্রাণ।
(গ) গণতন্ত্র সাম্য ও স্বাধীনতার আদর্শে বিশ্বাসী। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রীপুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমানাধিকার গণতন্ত্র স্বীকার করে। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সাম্য নীতিতে একনায়কতন্ত্র বিশ্বাসী নয়।
(ঘ) গণতন্ত্র একাধিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব স্বীকার করে। কিন্তু একনায়কতন্ত্র সকল বিরােধিতা বলপূর্বক দমন করে একদলীয় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে।
(ঙ) জনমত গণতন্ত্রের প্রাণবস্তু; জনমতের দ্বারাই সরকারের স্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে। একনায়কতন্ত্র আলাপ-আলােচনা বা মতবিনিময়ের পদ্ধতিতে বিশ্বাস করে না। যান্ত্রিক নিয়মানুবর্তিতা এবং পুলিশ মিলিটারির সাহায্যে সমগ্র জনজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করাই একনায়কতন্ত্রের লক্ষ্য।
(চ) স্বায়ত্তশাসনের নীতি গণতন্ত্র স্বীকার করে। নাগরিকের সহযােগিতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ সফলতা-ব্যর্থতার ওপর নির্ভর করে। একনায়কতন্ত্র স্বায়ত্তশাসনের নীতিতে বিশ্বাস করে না। ব্যক্তিগত যােগ্যতা, দক্ষতা, নেতৃপূজা একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য।
(ছ) গণতন্ত্রে বিভিন্ন দলের অস্তিত্ব, সাংগঠনিক দুর্বলতা, দলত্যাগ প্রভৃতি কারণে সরকারের ঘন ঘন পরিবর্তন হতে পারে। স্থায়ী শাসননীতির অভাব পরিলক্ষিত হয়। একনায়কতন্ত্রে রাজনৈতিক দলাদলির ওপরে উঠে বলিষ্ঠ দক্ষ নেতৃত্বে স্থায়ী শাসননীতি প্রবর্তন করতে পারে।
(জ) যুদ্ধ, বহিরাক্রমণ, অর্থনৈতিক সংকটজনিত জরুরি অবস্থায় গণতন্ত্র সার্থকভাবে কাজ করতে পারে না। কিন্তু একনায়কের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত বলে যে-কোনাে পরিস্থিতিতে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
(ঝ) গণতন্ত্রে জনগণ সরকারের সমালােচনা করতে পারে, এবং প্রয়ােজন হলে বিপ্লবের পথ ছাড়াই ব্যালটের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন করতে পারে। একনায়কতন্ত্র ব্যালট অপেক্ষা বুলেট এর ওপর বেশি আস্থাশীল। রক্তাক্ত বিপ্লবের মাধ্যম ছাড়া স্বৈরশাসনের অবসান ঘটানাে সম্ভব নয়।
(ঞ) গণতন্ত্র আন্তর্জাতিক সহযােগিতা, মৈত্রী ও শান্তির আদর্শে বিশ্বাস করে। একনায়কতন্ত্র জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বে আস্থাশীল বলে উগ্র জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করে। উগ্র জাতীয়তাবাদ যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে।
Comment

Class XI Political Science

Class XII Political Science

Class 12 Bangla Books Question& Answers